বর্তমানে পৃথিবী ধ্বংসের মুখে। আর এর মূল কারণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে বৈশ্বিক আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ দূষণ। সবকিছু যেভাবে চলছে এভাবেই চলতে থাকলে খুব তাড়াতাড়িই পৃথিবী বসবাসের অনুপযোগী একটি গ্রহে পরিণত হয়ে যাবে। তাহলে পৃথিবীর মানুষদের কি হবে? এই ভেবেই যেখানে বিজ্ঞানীরা চিন্তিত। সেখানে স্পেস এক্স এর প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক নিয়ে এসেছে এক নতুন যুগান্তকারী সমাধান।
তাঁর সমাধান মতে মঙ্গল গ্রহই হবে আমাদের দ্বিতীয় পৃথিবী। মঙ্গল গ্রহে যাওয়া পৃথিবীর সব নভোচারীদের স্বপ্ন হলেও তা পূরণের প্রথম পদক্ষেপ নিতে চলেছে স্পেস এক্স।
বিজ্ঞানীদের ধারণা মতে পৃথিবী ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে গেলেও মঙ্গল গ্রহ ও চাঁদ হবে পৃথিবীর ভবিষ্যত পর্যটন কেন্দ্র। এখন মানুষ যেভাবে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ায়, ঠিক তেমনি একদিন ঘুরে বেড়াবে গ্রহ-উপগ্রহে। যার পদক্ষেপ নিয়েছে স্পেস এক্স অ্যারোস্পেস কোম্পানি। চলুন একটু গভীর ভাবে যেনে নেই স্পসএক্স সম্পর্কে-
স্পেস এক্স কী?
স্পেস এক্সপ্লোরেশন টেকনোলজিস কর্পোরেশন (English: Space Exploration Technologies Corporation) যার সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে স্পেস এক্স একটি মার্কিন কোম্পানি, যা মূলত মহাকাশযান নির্মাণ করে এবং মহাকাশ যাত্রা সেবা প্রদান করে। স্পেস এক্স এর প্রধান কার্যালয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের হথর্ন নগরীতে অবস্থিত। স্পেস এক্স এর প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক একজন প্রযুক্তি ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা, মহাকাশ যাত্রা ও ভ্রমণ সহজলভ্য করা এবং মঙ্গল গ্রহে মানুষের বসবাসের স্বপ্ন নিয়ে ইলন মাস্ক ৬ মে, ২০০২ সালে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব্যক্তিগতমালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন।
২০০২ সালের আগে মহাকাশে যেকোনো কাজের জন্য মহাকাশযান পাঠানো থেকে শুরু করে মহাকাশযানে করে স্যাটেলাইট পাঠানো পর্যন্ত যাবতীয় কার্যকলাপ পরিচালনা করা হতো নিজ নিজ দেশের সরকারের মহাকাশ সংস্থার মাধ্যমে। রাশিয়ার রসকসমস, ভারতের ইসরো, আমেরিকার নাসা হলো অন্যতম অ্যারোস্পেস সরকারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ২০০২ সালে স্পেস এক্স নামের প্রাইভেট অ্যারোস্পেস ম্যানুফাকচারার কোম্পানিটি চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে, এই রীতিটির অবসান ঘটে। স্পেস এক্স-ই বর্তমানে পৃথিবীর একমাত্র কোম্পানি যারা তুলনামূলক ভাবে খুব কম খরচেই মহাকাশে পাঠানো সম্ভব এমন রকেট তৈরি করছে এবং সেই রকেট এর এক্সপ্লোরেশন থেকে রিকোভার পর্যন্ত যাবতীয় ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রন করছে।
স্পেস এক্স বর্তমানে একটি ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি হিসেবে কাজ করছে। স্পেস এক্স এর প্রধান কাজ হলো পৃথিবীর বাইরে কক্ষপথে থাকা ইন্টারন্যাশনাল স্পেস ষ্টেশনে কার্গো এবং গবেষণা সরঞ্জাম বা সামগ্রী সেবা পরিবহন করা।এছাড়াও স্পেস এক্স বিভিন্ন দেশের সরকার বা প্রতিষ্ঠানকে স্পেস-এ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে সাহায্য করে। ফ্যালকন ও ড্রাগন নামের মহাকাশযানে করে পৃথিবীর কক্ষপথে “পে-লোড” (যন্ত্রপাতি বা কৃত্রিম উপগ্রহ) পৌঁছে দেওয়া হয়।
ইলন মাস্ক এর সফলতার ইতিহাস
ইলন মাস্কের জন্ম ১৯৭১ সালের ২৮ জুন, দক্ষিন আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায়। ইলন রিভ মাস্ক জন্মসূত্রে একজন দক্ষিণ আফ্রিকান [(পিতৃসূত্রে) ১৯৭১–বর্তমান] ও কানাডিয়ান [(মাতৃসূত্রে) ১৯৭১–বর্তমান] নাগরিক। ২০০২ সালে ইলন বিনিয়োগকারী হিসেবে আমেরিকার নাগরিকত্ব লাভ করেন।
ইলন মাস্ক ছিলেন শৈশব থেকেই বই প্রেমিক একজন। মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা (Encyclopedia Britannica) পুরোটা পড়ে শেষ করে ফেলেছিলেন।
মাত্র দশ বছর বয়সে কমোডর ভিআইসি-২০ কম্পিউটার ব্যবহার করতে গিয়ে কম্পিউটারের উপর তাঁর আগ্রহের জন্ম নেয়। তিনি একটি বই (ব্যবহার নির্দেশিকা) ব্যবহার করে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখেন।
মাত্র বার বছর বয়সে তিনি বেসিক প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে একটি ভিডিও গেম তৈরী করেন, যার নাম ছিল ব্লাস্টার। ব্লাস্টার গেমটি ৫০০$ ডলারে তিনি পিসি এন্ড অফিস টেকনোলজি ম্যাগাজিনের কাছে বিক্রি করে দেন।
ছোট থাকতে ইলন মাস্ক আইজাক আসিমভের ফাউন্ডেশন সিরিজের বই পড়তেন। যেখান থেকে তিনি শেখেন “সভ্যতার বিকাশে, অন্ধকার যুগের সম্ভাবনা ও স্থায়িত্বকাল কমাতে পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ” ।
ইলন মাস্ক ওয়াটারক্লুফ হাউজ প্রিপারেটরি স্কুল এবং ব্রায়ানস্টোন হাই স্কুলে লেখাপড়া করেছিলেন। ইলন মাস্ক ছোটবেলায় প্রচুর বুলিং এর স্বীকার হয়েছিলেন। এক দল ছেলে তাকে সিড়ি থেকে ফেলে দিয়েছিল যার জন্য তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল।
সতের বছর বয়সে ১৯৮৯ সালেই মাস্ক দক্ষিন আফ্রিকা থেকে কানাডায় পাড়ি জমান শুধু মাত্র কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি এবং বাধ্যতামূলক সামরিক দায়িত্ব এড়িয়ে চলতে।
১৯৯২ সালে কানাডা ত্যাগ করে আমেরিকায় পাড়ি জমান পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসা ও পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়ন করার উদ্দেশ্যে। তিনি অর্থনীতিতে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করার পর পদার্থ বিজ্ঞানে আরেকটি ব্যাচেলর অর্জনের জন্য একই বিশ্ববিদ্যায়ে থেকে যান।
পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে জ্বালানী পদার্থ বিদ্যায় পিএইচডি করার উদ্দেশ্যে ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেই সময়েই ইন্টারনেট বিপ্লবের সূচনা হয় এবং এই বিপ্লবের অংশ হওয়ার জন্য মাস্ক মাত্র দুইদিন পিএইচডি প্রোগ্রামে কাজ করার পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় বের হয়ে যান।
জিপ টু: ইলন মাস্কের প্রথম কোম্পানি
তিনি তাঁর প্রথম কোম্পানী “জিপ টু” প্রতিষ্ঠা করেন। জিপ টু আসলে ছিল একটি অনলাইন সিটি গাইড সফটঅয়্যার টাইপ কোম্পানি।
প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নিউ ইয়র্ক টাইমস ও শিকাগো ট্রিবিউনের মত দু’টি প্রকাশনার কাছে তারা তথ্য বিক্রি করা শুরু করেন। ১৯৯৯ সালে কমপ্যাক কম্পিউটার্স ৩০৭ মিলিয়ন ডলার নগদ ও ৩৪ মিলিয়ন ডলারের স্টকের বিনিময়ে জিপ টু কিনে নেয়।
পেপ্যালের সহপ্রতিষ্ঠাতা
১৯৯৯ সালে মাস্ক তাঁর ভাইয়ের সাথে মিলে অনলাইন আর্থিক লেনদেন সেবাদাতা সাইট এক্স ডট কম প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী বছর নতুন কিছু বিষয় যোগ হওয়ার মাধ্যমে এক্স ডট কম পরিনত হয় আজকের পেপ্যাল নামক বহুল ব্যবহৃত অনলাইন ভিত্তিক আর্থিক লেনদেন সাইটে। ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে ১.৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের স্টকের মাধ্যমে ইবে পেপ্যাল-কে কিনে নেয়। বিক্রয়ের সময়ে মাস্ক পেপ্যালের ১১ শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিলেন। যার ফলে মাস্ক একজন মাল্টিমিলিয়নিয়ারে পরিনত হন।
স্পেস এক্স কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা
২০০২ সালে মাস্ক বানিজ্যিক মহাকাশ ভ্রমণ সেবা প্রদানের ও স্বল্পমূল্যে মহাকাশযান তৈরী করার উদ্দেশ্যে স্পেস এক্স কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি রকেটের সম্পর্কে এর আগে খুব বেশি কিছু জানতেন না। কিন্তু অল্পকিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিজেকে রীতিমত একজন রকেট বিজ্ঞানীতে পরিণত করেন। তিনি এটা কিভাবে সম্ভব করলেন জানতে চাইলে তাঁর উত্তর ছিল “আমি (এই বিষয়ে) অনেকগুলো বই পড়েছি।” ২০০৮ সালের ভেতরেই স্পেস এক্স একটি সুপ্রতিষ্ঠিত মহাকাশযান প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয় এবং আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে মালামাল পৌঁছানোর চুক্তি স্বাক্ষর করে – যার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় নাসার নিজস্ব মহাকাশযানের বদলে স্পেস এক্স এর যানে মহাকাশচারী আনা নেয়ার বিষয়ও ছিল ।
টেসলার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্ক
বিশ্ববিখ্যাত টেসলা মোটরস এর কথা জানে না এমন গাড়ি প্রেমীরা কমই আছে। এই অত্যাধুনিক গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটির সহ উদ্যোক্তা, প্রধান নির্বাহী ও প্রধান পন্য পরিকল্পনাকারী হলেন ইলন মাস্ক। কোম্পানীটি শুধুমাত্র সাধারনের ক্রয়সীমায় সেরা গাড়িগুলোই বানায় না, এর সাথে সাধারন ব্যবহার্য ইলেক্ট্রনিক্স, ব্যাটারী এবং সোলার রুফও প্রস্তুত করে। প্রতিটি পন্যের আইডিয়া সৃষ্টির থেকে শুরু করে ডিজাইন, প্রকৌশল ইত্যাদি সবই মাস্ক নিজে তত্বাবধান করেন। প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় টেসলা বিশ্বের সেরা একটি স্পোর্টস কার “রোডস্টার” বাজারে নিয়ে আসে। মাত্র ৩.৭ সেকেন্ডের মধ্যেই রোডস্টার ০ থেকে এর গতিবেগ ঘন্টায় ৬০ কিলোমিটারে নিয়ে যেতে সক্ষম। এছাড়াও গাড়িটি কোনওরকম জ্বালানী তেল ব্যা গ্যাস ছাড়া শুধুমাত্র এর লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারীর ওপর নির্ভর করে ২৫০ মাইল পাড়ি দিতে পারে। ডেইমলারের সাথে ব্যবসায়িক লেনদেন ও টয়োটার সাথে কারিগরী অংশীদারিত্ব নিয়ে ২০১০ সালের জুনে টেসলা প্রথমবারের মত পাবলিক লিমিডেট কোম্পানী হিসেবে স্টক মার্কেটে নামে অল্প সময়ের মধ্যেই যার মূল্য দাঁড়ায় ২২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
কোম্পানীর প্রথম ইলেকট্রিক সিডান “Model – S” বাজারে দারুন সফলতা লাভ করে। একবার ব্যাটারি ফুল চার্জ হলে এটি ২৬৫ মাইল পাড়ি দিতে সক্ষম। মোটর ট্রেন্ড ম্যাগাজিন মডেল এস কে ২০১৩ সালের সেরা গাড়ির মর্যাদা প্রদান করে।
ইলন মাস্কের বর্তমান ও উন্নত ভবিষ্যত
ইলন মাস্ক এখন মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ও আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজসকে টেক্কা দিয়ে নিজের নাম লিখিয়ে নিয়েছেন বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তালিকায়। বর্তমানে তার মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৯ হাজার ৫শ’ কোটি ডলার। গত বছরের শীর্ষ ধনী ব্যক্তি অ্যামাজান প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজসকে সরিয়ে এ স্থান নিজের দখলে নিলেন ইলন মাস্ক। বেজসের সাথে মাস্কের সম্পদের পার্থক্য এখন সাড়ে ৯শ’ কোটি ডলারের।
এখন পর্যন্ত আটটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন ইলন মাস্ক —টেসলা, স্পেস এক্স, হাইপারলুপ, ওপেন এআই, নিউরালিঙ্ক, দ্য বোরিং কোম্পানি, জিপ ২, পেপ্যাল ।
২০১৮ সালে ইলন মাস্ক ‘ফেলো অব দি রয়্যাল সোসাইটি’ নির্বাচিত হন। একই বছর ফোর্বস সাময়িকী ‘বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি’ তালিকায় ২৫ তম স্থানে তার নাম ঘোষণা করে। ২০১৯ সালে ফোর্বসের ‘আমেরিকার সবচেয়ে উদ্ভাবনী নেতৃত্ব’ তালিকায় যৌথভাবে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, তার অর্থের অর্ধেকই তিনি ব্যয় করবেন পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধানে আর বাকী অর্ধেক মঙ্গল গ্রহে আবাস তৈরীতে ব্যয় করবেন।
তাঁর মূল উদ্দেশ্য শুধু সম্পদ বৃদ্ধি না বরং সেই সম্পদকে পৃথিবীর কাজে লাগানো। এভাবেই সব চলতে থাকলে অবশ্যই ইলন মাস্ক পৌঁছে যাবে উন্নতির শেষ দ্বারে আর সাথে উন্নত হবে এ পৃথিবীও।
ইলন মাস্ক সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন
স্পেস এক্স এর সাফল্যের ইতিহাস
বিশ্বের প্রথম প্রাইভেট অ্যারোস্পেস কোম্পানি স্পেস এক্স এবং বিশ্বের সবচেয়ে সফল অ্যারোস্পেস কোম্পানিও স্পেস এক্স।
স্পেস এক্স কোম্পানিটি ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এটি সাফল্যের মুখ প্রথম বারের মতো দেখে ২০০৮ সাথে। এর পর অবশ্য কোম্পানিটিকে খুব অসফলতার মূখ দেখতে হয়নি আর।
২০১০ সাল থেকে এই পর্যন্ত প্রায় ১০৭টি স্পেস মিশন পরিচালনা করেছে স্পেস এক্স, যার মধ্যে ১০৫টি মিশন শতভাগ সফল হয়েছে। একটিতে আংশিক ব্যর্থতা এবং একটিতে মহাকাশযানের সম্পূর্ণ সর্বনাশ ঘটেছে (৮ই’ জানুয়ারি, ২০২১ পর্যন্ত)। সফলতার এই রেকর্ড পৃথিবীর সব স্পেস কোম্পানিকে হার মানিয়েছে।
২০০২ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিন বার ব্যর্থ হয়ে, পেপ্যাল থেকে পাওয়া তাঁর শেয়ারের ১৮০ মিলিয়ন ডলার শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও হার মানেননি ইলন মাস্ক । শেষ প্রচেষ্ঠা করতে নিজের সব কিছু বিক্রি করতে হয় ইলনকে। আর এই ঝুঁকিই নিয়ে আসে স্পেস এক্স এর সাফল্য।
ফ্যালকন-১ এর সফলতার পর ইলন মাস্ক একমাত্র ব্যক্তি যিনি এটা দাবি করতে পারেন যে তিনি ব্যক্তিগত একটি অ্যারোস্পেস কোম্পানির মালিক। শুরু থেকে স্পেস এক্স মোট ১৫টি রেকর্ড করেছে যার সবগুলোই নতুন রেকর্ড। আর এর জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিও নিয়েছে স্পেস এক্স, যা বিশ্বের অন্য কোনো অ্যারোস্পেস কোম্পানি নেয়নি।
ফ্যালকন-১ সফলতার পর থেকে এই পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন সক্ষমতা ও আকারের ১০টি রকেট ডেভেলপ করেছে স্পেস এক্স। ফ্যালকন-৯ এর পর থেকে প্রতিটি রকেটই দামে এবং আকারে পৃথিবীর বিস্ময় বলে ধরা হয়।
ড্রাগন, ফ্যালকন-৯, ফ্যালকন-৯ হেভির মতো সব রকেট স্পস এক্স এরই তৈরী।
কিভাবে আয় করে স্পেস এক্স এবং কারা স্পেস এক্স এর কাস্টমার?
স্পেস এক্স এর অর্থ আয় করার এখন পর্যন্ত মাত্র দুইটি পথ রয়েছে। একটি হলো আন্তর্জাতিক মহাকাশ কক্ষপথে স্যাটেলাইট পাঠানো ও অন্যটি হলো আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা স্টেশন গুলোতে বিভিন্ন মালামাল ও গবেষকদের পাঠানো। মোট কথা স্পেস এক্স এর অর্থ আয়ের মাধ্যম হচ্ছে ট্রান্সপোর্টেশন।
বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ ও স্পেস এক্স ফ্যালকন-৯ এর মাধ্যমেই পাঠানো হয়েছে। এখানে বাংলাদেশ স্পেস এক্স এর কাস্টমার ছিল। আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন নিয়ে কাজ করছে এমন বেশিরভাগ কোম্পানিই স্পেস এক্স এর কাস্টমার।
এর মধ্যে রয়েছে পৃথিবীর সবথেকে বড় পাঁচটি টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি। যেগুলো হলো eutelsat, THAICOM, ECHOSTAR, ORBCOMM, ABS। এছাড়াও NASA ও আমেরিকান আর্মিও তাদের প্রয়োজনে স্পেস এক্স-কে ব্যবহার করে থাকে।
প্রতিটি মিশনের জটিলতা ও সময়ের উপর বিবেচনা করে মূল্য নির্ধারণ করা হয়। ফ্যালকন-৯ এর স্টার্টিং প্রাইজ হচ্ছে ৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ( যার অফিসিয়াল প্রাইজের সাথে যুক্ত হতে পারে আরও ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) আর ফ্যালকন হেভির স্টার্টিং প্রাইজ হচ্ছে ৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (যার অফিসিয়াল প্রাইজের সাথে যুক্ত হতে পারে আরও ২০-২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)। কিন্তু এই পর্যন্ত মাত্র একটি মিশন ফ্যালকন হেভির মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়েছে আর তাও ছিল সফল।
স্পেস এক্স বর্তমানে একমাত্র কোম্পানি যা একটি মিশন শেষে রকেটকে অক্ষত ভাবে পৃথিবীর বুকে ল্যান্ডিং করাতে সক্ষম। যা NASA-র পক্ষে এখনো করা সম্ভব হয়নি।
স্পেস এক্স এর বর্তমান প্রকল্প
স্টারলিংক (StarLink) নামক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে স্পসএক্স, যা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করবে সারা বিশ্ব। এই প্রকল্পের জন্য স্পেস এক্স মোট ৪২ হাজার স্যাটেলাইট মহাকাশে প্রেরণ করবে, যার কাজ হবে লেজার টেকনোলজি ব্যবহার করে পৃথিবীর প্রতিটা জায়গায় ইন্টারনেট সেবা দেওয়া। ইতিমধ্যে ৮০০ স্যাটেলাইট প্রেরনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এটি যদি সম্ভব হয় তাহলে পৃথিবী অনেক অনেক দূর এগিয়ে যাবে এবং যোগাযোগ অনেক সহজ হবে।
চাঁদ হবে পর্যটন কেন্দ্র
“স্টারশিপ” নামে এক নতুন স্পেসক্রাফটের উদ্ভাবন করেছে স্পেস এক্স। যার মাধ্যমে ট্যুর দেওয়া হবে স্পেসে। প্রতি বছর স্পেস এক্স থেকে মাত্র একটি ট্যুর দেওয়া হবে। যার প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে। ইতি মধ্যে স্টারশিপ এর টেস্ট করা হয়েছে যা দুর্ভাগ্যক্রমে অসফল ছিল। কিন্তু এখনও এটি সফল করতে মনে প্রাণে লেগে আছে স্পেস এক্স এর বিজ্ঞানীরা।
মঙ্গলে আবাস নির্মাণে স্পেস এক্স
স্পেস এক্স কিন্তু এখানেই থেমে রয়নি, বরং নির্মাণ করতে যাচ্ছে মঙ্গল গ্রহে পৃথিবীর নতুন আবাস স্থল। যার প্রস্তুতি চলছে খুব জোরে-শোরে। ২০২২ সালেই পাঠানো হবে মঙ্গল গ্রহে একটা কার্গো শিপ। যার মধ্যে করে পাঠানো হবে মানুষের প্রয়োজনিয় সব দ্রব্যাদি। কার্গো শিপটি মঙ্গল গ্রহে পাঠানো হবে স্পেস এক্স এরই এয়ারক্রাফট ফ্যালকন-৯ এর মাধ্যমে।
সব কিছু ঠিক থাকলে ২০২৪ সালে পাঠানো হবে মঙ্গল গ্রহে ট্রেইন করা ৬ জন নভোচারী। তাঁরা সেখানে সফলভাবে সারভাইভ করতে পারলে এর পরের কিছু বছর পাঠানো হবে ট্রেইন্ড সব সাইন্টিস্টদের। সব কিছু স্বাভাবিক থাকলে আস্তে আস্তে বিস্তৃত করা হবে কলোনিটি। আর এভাবেই তৈরি করা হবে মঙ্গল গ্রহে এক নতুন বসতি।
স্পেস এক্স ও ইলন মাক্সের উজ্জ্বল ভবিষ্যত
স্পেস এক্স যে জোরকদমে সামনের দিকে বাড়ছে তা সবার চোখের সামনে। স্পেস এক্স এর সকল পরিকল্পনা সফল হলে খুব তাড়াতাড়িই পৃথিবীর মানুষ পারি জমাবে মঙ্গল ও চাঁদে। স্পেস এক্স এর এই সাফল্যের জন্য গুগল সহ বড় বড় কোম্পানিগুলো ইনভেস্ট করছে স্পেস এক্স-এ।
দেখতে দেখতে ইলন মাস্ক বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তালিকায় নাম লিখিয়ে নিয়েছেন নিজের। যা ঘটেছে চলতি বছরের শুরুতেই। খুব তাড়াতাড়ি তিনি পৌঁছে যাবেন ত্রিলিয়নের ঘরে। উজ্জ্বল ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে ইলন মাস্কের জন্য।
তথ্যসূত্র: Wikipedia, ইন্টারনেট