বৈজ্ঞানিক স্যার জগদীশচন্দ্র বসু

বৈজ্ঞানিক স্যার জগদীশচন্দ্র বসু

যে দেশবরেণ্য কৃতী বিজ্ঞানী জগৎসভায় আমাদের দেশের মুখোজ্জ্বল করেছেন, যিনি নতুন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও আবিস্কারের দ্বারা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেশমাতৃকার সুনাম বৃদ্ধি করেছেন তিনি হলেন বৈজ্ঞানিক স্যার জগদীশচন্দ্র বসু।

জন্ম ও বংশ পরিচয়

জগদীশচন্দ্র বসু ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের অন্তর্গত শ্রীনগর থানার রাঢ়িখাল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জগদীশচন্দ্রের পিতার নাম শ্রী ভগবানচন্দ্র বসু ও মাতার নাম বামাসুন্দরী দেবী। ভগবানচন্দ্র সরকারি উচ্চপদে চাকুরি করতেন।

শিক্ষাজীবন

ফরিদপুরের পাঠশালায় জগদীশচন্দ্রের লেখাপড়া শুরু হয়। তারপর কলকাতার হেয়ার স্কুলে এবং পরে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে তাকে ভর্তি করা হয়। শিশুকাল থেকে জগদীশচন্দ্র পশু, পাখি, গাছ, লতা, পাতা, নদী, পর্বত ইত্যাদি বিষয়ে জানার কৌতুহল প্রকাশ করতেন। দেশীয় ছোট ছোট কলকারখানায় গিয়ে যন্ত্রপাতি কিভাবে তৈরি হয় এবং ওসব দিয়ে কিভাবে কাজ করা হয় তিনি লক্ষ্য করতেন।

সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল থেকে বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পাস করে তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। কলেজের শিক্ষক বিখ্যাত পণ্ডিত ফাদার লাঁফ তাকে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় যত্নের সাথে পড়াতেন। তখন থেকেই জগদীশচন্দ্র বিজ্ঞানের রহস্য নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি এফ, এ ও বি, এস্ সি পরীক্ষা পাস করেন।

বিদেশ গমন

১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে জগদীশচন্দ্র চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ার জন্যে বিলাত যান। বার বার অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে ডাক্তারি বিদ্যা ছেড়ে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইস চার্চ কলেজে ভর্তি হন। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র ও উদ্ভিদবিজ্ঞানে একসাথে অনার্স পান। একই সময়ে জগদীশচন্দ্র লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এস. সি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেশে ফিরে আসেন।

বিবাহ

১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি অবলা দাসকে বিবাহ করেন। তাদের কোনো সন্তান ছিল না।

কর্মজীবন

দেশে ফিরে তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। অল্পদিনের মধ্যে তিনি অধ্যাপনায় সুখ্যাতি অর্জন করেন বটে কিন্তু তিন বছর তাকে বিনা বেতনেই কাজ করতে হয়। ইংরেজ কর্মচারীদের তুলনায় ভারতীয় কর্মচারীদের কম বেতন দেবার প্রতিবাদে তিনি বেতন গ্রহণ করেন নি। অধ্যাপনার অবসরে তিনি গবেষণার কাজ করতেন। তার গবেষণার যন্ত্রপাতি তিনি দেশীয় কারিগরদের দ্বারা অল্প খরচে তৈরি করাতেন।

আবিষ্কার

জগদীশচন্দ্র প্রথমে অদৃশ্য আলোকের ধর্ম ও তরঙ্গ-দৈঘ্য নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি অদৃশ্য আলোকের তরঙ্গ- দৈঘ্য উৎপাদক (Coherer) কোহিয়ারার যন্ত্রের উন্নতি সাধন করেন। তারপর তার সাড়া জাগানো আবিষ্কার হলো ‘বিনা তারে বার্তা প্রেরণ’। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে জনগণের সামনে তিনি এটা প্রদর্শন করেন। এ বিষয়ে তার প্রথম নিবন্ধ ‘এশিয়াটিক সোসাইটি পত্রিকায়’ প্রকাশিত হয়। ১৮৯৬ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি. এসসি উপাধিতে ভূষিত করে।

জগদীশচন্দ্র জীবনের বাকি অংশ উদ্ভিদজগতের রহস্য সন্ধানে কাটিয়ে দেন। তিনি উদ্ভিদের জন্ম, মৃত্যু, বৃদ্ধি, উত্তেজনা, সাড়া দেবার পদ্ধতি ইত্যাদি একে একে আবিষ্কার করেন। পাশ্চাত্য থেকে এসব আবিষ্কারের স্বীকৃতি আদায়ে তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় এবং এরই ফলে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি ও লিলিয়ান সোসাইটিতে তিনি তার মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। তার উদ্ভিদজগৎ বিষয়ক আবিষ্কারসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গাছের বৃদ্ধি মাপার যন্ত্র-‘ক্রেস্কোগ্রাফ’ (Crescograph) ও উত্তেজনা নিরূপণের সমতাল তরুলিপি যন্ত্র (Resonant recorder) জগদীশচন্দ্র ইংরেজিতে তার আবিষ্কারের বিষয়ে নয়টি গ্রন্থ রচনা করেন।

বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা

বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের অন্যতম কৃতিত্ব হলো ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ প্রতিষ্ঠা। তার সারা জীবনের সঞ্চয় ও প্রাপ্ত দানের সাহায্যে তিনি ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে তার জন্মদিনে এই বিজ্ঞান গবেষণাগার উদ্বোধন করেন।

দেশ-বিদেশে সম্মান

জগদীশচন্দ্র দেশ-বিদেশে বহু সম্মানে সম্মানিত হন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ এবং বহু ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তাকে ডি. এসসি উপাধি প্রদান করে। দেশকে ভালোবাসতেন বলে তিনি বিদেশিদের দেওয়া বহু লোভনীয় চাকুরির প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, দার্শনিক ও চিন্তাবিধ রোমা রোঁলা, নাট্যকার জর্জ বার্নাড শ, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন প্রমুখ মনীষীর শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্ব অর্জন করেন। প্রফেসর প্যাট্রিক গ্যাডিস নামক একজন ভারত প্রেমিক স্কটিশ ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে জগদীশচন্দ্রের প্রথম গ্রন্থ ইংরেজিতে অনুবাদ করে প্রকাশ করেন।

মৃত্যু

এই মহান বিজ্ঞানী ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ নভেম্বর সকাল দশটায় বিহারের গিরিডি নামক স্থানে পরলোক গমন করেন। তার অবদানের কথা দেশ-বিদেশে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবে।