কবি সুফিয়া কামাল পরিচিতি

কবি সুফিয়া কামাল পরিচিতি

বাঙালি মুসিলম সমাজের অন্ধকার নিগড় থেকে যে কিশোরী বালিকা একদিন আপন সাহস ও সংগ্রামে জয় করে সমগ্র বাঙালি জাতির শ্রদ্ধার আসনে বিভূষিত হয়েছিলেন তিনি- কবি সুফিয়া কামাল। সুফিয়া কামাল এদেশের পিছিয়ে পড়া নারী সমাজকে শিক্ষা-দীক্ষায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে উৎসাহ ও প্রেরণা যুগিয়েছেন জীবনভর। তিনি ছিলেন এ দেশের নারী সমাজের জাগরণের অগ্রজ নেত্রী বেগম রোকেয়ার উত্তরসূরি। বাঙালি মুসলিম মহিলাদের মধ্যে কাব্য ও সাহিত্যচর্চায় তিনি যেমন এক প্রধান ব্যক্তিত্ব তেমনি সামাজিক শক্তির ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অনন্য সাহসের উৎস।

সুফিয়া কামাল জীবনকথা

কবি সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদ গ্রামের রাহাত মঞ্জিলে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম সৈয়দ আবদুল বারী এবং মায়ের নাম সৈয়দ সাবেরা খাতুন। সুফিয়া কামালের বয়স যখন মাত্র এক বছর তখন তার বাবা নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তিনি নানার বাড়িতে মায়ের কাছে পর্দার অন্তরালে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বেড়ে উঠেন।

তার মা জমিদার বংশের মেয়ে, আরবি ফারসির সঙ্গে বাংলা ভাষাও তিনি জানতেন। কাজেই মায়ের কাছে শেখা পড়াশোনা আর মামার বাড়ির সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারের বই পড়ে নিজেকে তিনি সুশিক্ষিত করে তুলেছিলেন। সুফিয়া কামালের জীবনে মোড় পরিবর্তন ঘটে সাত বছর বয়সে। এ সময় তিনি কলকাতায় বেড়াতে গিয়ে বেগম রোকেয়ার সাক্ষাৎ পান। বেগম রোকেয়ার বিরাট প্রভাব পড়ে তার জীবনে।

মাত্র ১৩ বছর বয়সে মামাতো ভাই নেহাল হোসেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ১৪ বছর বয়সে বেগম সুফিয়া কামালের একটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয় বরিশাল শহর থেকে প্রকাশিত ‘তরুণ’ পত্রিকায়। এজন্য তাকে আপন পরিবার ও সমাজের নানা অপবাদ সইতে হয়। সকলেই তার এ ধরনের কাজের নিন্দা করেন।

শায়েস্তাবাদে জমিদারি চলে গেলে কবির নানাবাড়িতে নানা দুঃখদৈন্য নেমে আসে। তারা কলকাতা প্রবাসী হন। ‘তরুণ’ পত্রিকার লেখাটি এক সময় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের চোখে পড়ে। তিনি উৎসাহ যুগিয়ে দীর্ঘ চিঠি লিখেন কিশোরী সুফিয়াকে। এতে তার জীবনে ঘটে আরেক নতুন আশার জোয়ার।

মাত্র ন’ বছর সংসার জীবনের পর স্বামী নেহাল হোসেনের মৃত্যুতে তাকে বৈধব্য বরণ করতে হয়। সে সময় তিনি সাহস না হারিয়ে কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে আপন অর্জিত বিদ্যার উপর নির্ভর করে দশ বছর শিক্ষকতা করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রস্থ ‘সাঝের মায়া’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ সালে।

সুফিয়া কামাল নতুন জীবন

১৯৩৯ সালে চট্টগ্রাম জেলার চুনতি গ্রামের জনাব কামাল উদ্দিনের সঙ্গে তার দ্বিতীয় সংসার রচিত হয়।

সুফিয়া কামাল তার সাহিত্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের আর্শীবাণীতে ধন্য হন, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী, কবি কামিনী রায় প্রমুখ বরেণ্য ব্যক্তিদের নিকটে আসার সুযোগ পান। এতে তার সামাজিক দৃষ্টি অনেকটা প্রসারিত হয়।

সুফিয়া কামাল কাব্যচর্চা

কবি সুফিয়া কামাল সহজ সরল মমতায় ভরা ভাষায় কাব্য রচনা করেছেন। তার কবিতার ভাষা ও ছন্দ খুব সহজ। তিনি প্রচুর শিশুতোষ ছড়া ও কবিতা লিখেছেন।

সুফিয়া কামালের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলো ‘সাঝের মায়া’, ‘মায়া কাজল’, ‘মন ও জীবন’, উদাত্ত পৃথিবী’, ‘দীওয়ান ও মৃত্তিকার ঘ্রাণ’,। তার শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থ হলো- ‘ইতল বিতল’, ‘নওল কিশোরের দরবার’, গল্পগ্রন্থ- ‘কেয়ার কাটা’, ভ্রমণ- ‘কাহিনী’, ‘সোভিয়েটের দিনগুলি’, আত্মজীবনী- ‘একালে আমাদের কাল’, ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি’- ‘একাত্তরের ডায়েরী’,। মহিলা সমিতি ও এ দেশের প্রধান শিশু-কিশোর সংগঠন কচি কাঁচার মেলার তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, তার গৃহাঙ্গনেই জন্মলাভ করে কচি কাঁচার মেলা। মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিরও তিনি ছিলেন প্রধান প্রাণপুরুষ।

সুফিয়া কামাল পুরস্কার ও সম্মান

কবি সুফিয়া কামাল তার সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনে মানুষের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন। তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মানে বিভূষিতও হয়েছিলেন।

সুফিয়া কামাল মৃত্যু

সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনে যিনি নানা সংগ্রাম ও সংকটে বাঙালি জাতির বিবেকের মতো আলোকবর্তিকা দেখিয়েছেন। তিনি কখনো কোনো প্রকার ক্ষমতার কাছে মাথা নত করেন নি। তিনি নিজের আদর্শ ও নিরপেক্ষতা থেকে বিচ্যুত হন নি। কবি সুফয়া কামাল ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর রোজ শনিবার সকাল সাড়ে আটটার সময় ঢাকার বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সুফিয়া কামাল রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন ও শত সহস্র মানুষের ভালোবাসা

কবি সুফিয়া কামালকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা আন্দোলনে শহীদ বরকতের কবরের পাশে। গোধূলির সূর্য্য যখন শেষ অস্তরাগে তখন ‘সাঁঝের মায়া’র কবিকে এক করুণ বিষণ্ন বিভামণ্ডিত পরিবেশে অন্তিম শয়ানে শুইয়ে দেখা হয়। সেনাবাহিনীর ‘লাস্ট বিউগলের’ করুণ মূর্চ্ছনা তখন বেজে উঠে। এর আগে কবির মরদেহ শহীদ মিনারে রাখা হয়। জনগণের শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপনের জন্য। অতঃপর জাতীয় ঈদগাহে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলা ভাষার প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক ও কবি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী কবি সুফিয়া কামালকে অভিহিত করেছেন। ‘বাংলার সাহিত্য জননী’ বলে। প্রকৃতপক্ষে, তিনি ছিলেন সত্যিই তাই। তিনি ছিলেন বাঙালির মাতৃস্বরূপা।