সৌরজগৎ এর আদ্যোপান্ত

সৌরজগৎ

সৌরজগৎ হল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সূর্য-প্রদক্ষিণকারী তথা পরস্পরের প্রতি অভিকর্ষজ টানে আবদ্ধ মহাজাগতিক বস্তুগুলিকে নিয়ে গড়ে উঠা এমন একটি ব্যবস্থা যা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্রস্থল থেকে ২৬,০০০ আলোকবর্ষ দূরে কালপুরুষ বাহুতে এই গ্রহ ব্যবস্থাটি অবস্থিত। সৌরজগতে প্রত্যক্ষভাবে সূর্য-প্রদক্ষিণকারী বস্তুগুলির মধ্যে আটটি গ্রহই বৃহত্তম।অন্য ক্ষুদ্রতর বস্তুগুলির মধ্যে রয়েছে বামন গ্রহ ও সৌরজগতের ক্ষুদ্র বস্তুসমূহ। পরোক্ষভাবে সূর্য-প্রদক্ষিণকারী বস্তুগুলির মধ্যে দুইটি প্রাকৃতিক উপগ্রহ ক্ষুদ্রতম গ্রহ বুধের থেকেও আকারে বড়ো।

৪.৬ লক্ষ কোটি বছর আগে একটি দৈত্যাকার আন্তঃনাক্ষত্রিক আণবিক মেঘের মহাকর্ষীয় পতনের ফলে সৌরজগতের উদ্ভব ঘটেছিল। সমগ্র সৌরজগতের ভরের অধিকাংশ অংশই রয়েছে সূর্যে এবং অবশিষ্ট ভরের অধিকাংশ ধারণ করে রয়েছে বৃহস্পতি। চারটি ক্ষুদ্রতর অভ্যন্তরীণ গ্রহ, অর্থাৎ বুধ, শুক্র, পৃথিবী ও মঙ্গল হল শিলাময় গ্রহ। এগুলি প্রধানত শিলা ও ধাতু দ্বারা গঠিত। চারটি বহিঃস্থ গ্রহ হল দানব গ্রহ। কারণ, বস্তুগত দিক থেকে এগুলি শিলাময় গ্রহগুলির তুলনায় অনেক বেশি ভরযুক্ত। এগুলির মধ্যে বৃহত্তম গ্রহ দুইটি হল বৃহস্পতি ও শনি। মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দ্বারা গঠিত বলে এগুলি গ্যাস দানব নামে পরিচিত। অপর দুই সর্ববহিঃস্থ গ্রহ ইউরেনাস ও নেপচুন তুষার দৈত্য নামে পরিচিত। কারণ এগুলির প্রধান উপাদান হল জল, অ্যামোনিয়া ও মিথেনের মতো উদ্বায়ী, যেগুলি হাইড্রোজেন ও মিথেনের তুলনায় আপেক্ষিকভাবে উচ্চ গলনাঙ্ক-যুক্ত। আটটি গ্রহই ক্রান্তিবৃত্ত নামে পরিচিত একটি প্রায় চ্যাপ্টা চাকতির ভিতর প্রায় বৃত্তাকার কক্ষপথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে।

planets iau

Image Source : Universe Today

অসংখ্য ক্ষুদ্রতর বস্তুও সৌরজগতের অন্তর্গত।মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথের মধ্যবর্তী অঞ্চলে সঞ্চরণশীল গ্রহাণু বেষ্টনীর অন্তর্গত বস্তুগুলির উপাদান শিলাময় গ্রহগুলির মতোই শিলা ও ধাতু। নেপচুনের কক্ষপথের বাইরে অবস্থিত কাইপার বেষ্টনী ও বিক্ষিপ্ত চাকতি অঞ্চলে রয়েছে নেপচুন-উত্তর বস্তুগুলি। এই বস্তুগুলি মূলত বরফে গঠিত এবং এগুলিরও বাইরে সাম্প্রতিককালে আবিষ্কৃত হয়েছে সেডনয়েডের সমারোহ। এই সকল বস্তুর মধ্যে কয়েকটির আকার এতটাই বড়ো যে সেগুলির অভিকর্ষজ টান সেগুলিকে গোলকের আকার দানের পক্ষে যথেষ্ট। তবে এই জাতীয় সঠিক কতগুলি বস্তু ওই অঞ্চলে রয়েছে তা এখনও প্রমাণিত নয় বলে সেই বিষয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে। এই ধরনের বস্তুগুলিকে বামন গ্রহের শ্রেণিভুক্ত করা হয়। চিহ্নিত অথবা স্বীকৃত বামন গ্রহগুলির অন্যতম হল সেরেস এবং নেপচুন-উত্তর বস্তু প্লুটো ও এরিস। এই দুই অঞ্চল ছাড়াও অন্য বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্রাকার বস্তু, যেমন ধূমকেতু, সেন্টোর ও আন্তঃগ্রহ ধূলি মেঘ সৌরজগতের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে মুক্তভাবে সঞ্চরণশীল। ছয়টি গ্রহ, ছয়টি বৃহত্তম সম্ভাব্য বামন গ্রহ এবং অনেক ক্ষুদ্রাকার বস্তুকে প্রদক্ষিণকারী প্রাকৃতিক উপগ্রহেরও অস্তিত্ব আছে।পৃথিবীর চাঁদের নামানুসারে এগুলিকে সাধারণভাবে “চাঁদ” বলে উল্লেখ করা হয়। প্রত্যেকটি বহিঃস্থ গ্রহকেই ঘিরে রয়েছে অন্যান্য ক্ষুদ্র বস্তু দ্বারা গঠিত একটি করে গ্রহীয় বলয়।

সূর্য থেকে বাইরের দিকে প্রবহমান বৈদ্যুতিক আধান-যুক্ত কণার একটি স্রোত সৌর বায়ু নামে পরিচিত। এটি সৌরগোলক নামে পরিচিত আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমে একটি বুদবুদ-তুল্য অঞ্চল সৃষ্টি করেছে। সৌরবিরতি হল সেই বিন্দু যেখানে সৌর বায়ুর চাপ আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমের বিপরীত চাপের সমান; এটি বিক্ষিপ্ত চাকতির সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত। দীর্ঘকালীন ধূমকেতুগুলির উৎসস্থল হিসাবে বিবেচিত উর্ট মেঘ সম্ভবত সৌরবিরতির থেকে মোটামুটি এক হাজার গুণ দূরত্বে অবস্থিত।

সৌরজগৎ আবিষ্কার ও অভিযান

সভ্যতার ইতিহাসে অধিকাংশ সময় জুড়েই মানবজাতি সৌরজগৎ সম্পর্কে নানা ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে এসেছিল। পরবর্তী মধ্যযুগ ( রেনেসাঁ পর্যায়) পর্যন্ত প্রচলিত বিশ্বাস ছিল যে, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রস্থলে স্থির হয়ে রয়েছে এবং বিন্যাসগত দিক থেকে সেটির সঙ্গে আকাশে সঞ্চরণশীল দিব্য অথবা বায়বীয় বস্তুগুলির বিশেষ পার্থক্য রয়েছে।প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টারকাস সূর্যকেন্দ্রিক ব্রহ্মাণ্ড-বিন্যাসের কথা চিন্তা করলেও নিকোলাস কোপার নিকাসই প্রথম সূর্যকেন্দ্রিক গ্রহব্যবস্থার গাণিতিক প্রমাণ উপস্থাপন করেন।

সপ্তদশ শতাব্দীতে গ্যালিলিও প্রথম  সৌরকলঙ্ক  ও বৃহস্পতির চারটি প্রাকৃতিক উপগ্রহ আবিষ্কার করেন। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ কর  ক্রিস্টিয়ান হিউজেন্স আবিষ্কার করেন শনির উপগ্রহ টাইটান  ও শনির বলয়ের   বিশেষ আকৃতিটি। ১৭০৫ সালে এডমন্ড হ্যালি  উপলব্ধি করেন, একটি বিশেষ ধূমকেতুই প্রতি ৭৫-৭৬ বছর অন্তর ফিরে আসে। এইভাবেই প্রথম প্রমাণিত হয় যে, গ্রহ ছাড়া অন্য মহাজাগতিক বস্তুও সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে।  এই সময়েই সৌরজগৎ শব্দের ইংরেজি   “সোলার সিস্টেম” (“Solar System”) প্রতিশব্দটি প্রথম চালু হয়।১৮৩৮ সালে ফ্রেডরিখ বেসেল  সফলভাবে একটি নাক্ষত্রিক লম্বন দৃষ্টিভ্রম  পরিমাপ করেন। এই দৃষ্টিভ্রমটির কারণ সূর্য-প্রদক্ষিণকালে পৃথিবীর গতির মাধ্যমে সৃষ্ট একটি নক্ষত্রের আপাত স্থানান্তর। এই পরিমাপটি ছিল সূর্যকেন্দ্রিকতাবাদের প্রথম প্রত্যক্ষ পরীক্ষামূলক প্রমাণ।বর্তমানে পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞানের উন্নতি এবং মনুষ্যবিহীন মহাকাশযানের  ব্যবহারের ফলে সূর্য-প্রদক্ষিণকারী অন্যান্য জ্যোতিষ্কগুলিকে বিস্তারিতভাবে অনুসন্ধান করা সম্ভব হয়েছে।

p

সৌরজগৎ এর সামগ্রিক চিত্র;Image Source : Wikipedia

 

সৌরজগৎ এর গঠন কাঠামো

সূর্য

সূর্য সৌরজগতের মাতৃতারা ও এর প্রধানতম উপাদান। সূর্যের ভর অনেক বেশি। এই ভরের কারণে অভ্যন্তরভাগে যে বিপুল ঘনত্বের সৃষ্টি হয় তা-ই নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়াকে চলমান রাখে । এই বিক্রিয়ার কারণে বিপুল শক্তি নির্গত হয় যে শক্তির অধিকাংশ বিভিন্ন তরিচ্চুম্বকীয় বিকিরণ যেমন দৃশ্যমান বর্ণালী হিসেবে মহাকাশে নির্গত হয় ।  

তারার শ্রেণীবিন্যাস অনুসারে সূর্য মাঝারি ধরনের  হলুদ বামন  শ্রেণীতে পড়ে। কিন্তু সূর্যবে এভাবে খাটো করা এক দিক দিয়ে ঠিক হবে না। কারণ আমাদের ছায়াপথের অন্যান্য তারার তুলনায় সূর্য বেশ বড় এবং উজ্জ্বল। হের্টস্‌স্প্রুং-রাসেল চিত্র অনুসারে তারাসমূহের শ্রেণীবিন্যাস করা হয়। এটা প্রকৃতপক্ষে তারার পৃষ্ঠীয় তাপমাত্রার বিপরীতে উজ্জ্বলতাকে স্থাপন করে অঙ্কিত একটি লেখচিত্র। সাধারণত, তারার উত্তাপ যত বেশি হয় তার উজ্জ্বলতাও তত বেশি হয়। চিত্রের এই গড়নকে যে তারাগুলো অনুসরণ করে তারা প্রধান ধারায় আছে বলে ধরে নেয়া হয়। সূর্যের অবস্থান এর ঠিক মধ্যখানে। সূর্যের চেয়ে উজ্জ্বল এবং উত্তপ্ত তারা বেশ বিরল হলেও তার থেকে কম উজ্জ্বলতা এবং উত্তাপবিশিষ্ট তারার সংখ্যা অনেক।

6320027 EdC8Q4TWsAQxK7z

Image Source : ABC13

প্রধান ধারার যেখানে সূর্য আছে তা থেকে বোঝা যায়, বর্তমানে সে তার জীবনকালের মুখ্য সময়ে আছে। অর্থাৎ সেখানে নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় হাইড্রোজেনের ভাণ্ডার এখনও ফুরিয়ে যায়নি। সূর্যের উজ্জ্বলতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ইতিহাসের একেবারে প্রাথমিক সময়ে এর উজ্জ্বলতা বর্তমান থেকে শতকরা ৭৫ ভাগ বেশি ছিল।সূর্যের হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের অনুপাত নির্ণয়ের মাধ্যমে জানা গেছে সে তার জীবনকালের মাঝামাঝি পর্যায়ে আছে। এক সময় সে প্রধান ধারা থেকে সরে যাবে, ক্রমান্বয়ে বড়, উজ্জ্বল, শীতল ও লাল হতে থাকবে। এভাবে ৫০০ কোটি বছরের মধ্যে লোহিত দানবে পরিণত হবে। সে সময় তার দীপন ক্ষমতা হবে বর্তমানের চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি।সূর্য পপুলেশন ১ তারা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অর্থাৎ মহাবিশ্বের বিবর্তনের শেষ পর্যায়ে এটি গঠিত হয়েছে। এতে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের চেয়ে ভারী মৌলের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত প্রবীণ পপুলেশন ২ তারার তুলনায় বেশি। হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের চেয়ে ভারী মৌলগুলো প্রাচীন ও বিস্ফোরিত তারার কেন্দ্রে প্রথমবারের মত গঠিত হয়েছিল। তাই মহাবিশ্ব এই ভারী পরমাণু দিয়ে সমৃদ্ধ হওয়ার পূর্বেই প্রথম প্রজন্মের তারাগুলো মৃত্যুবরণ করেছিল। প্রাচীনতম তারাগুলোতে ধাতু (হিলিয়াম পরবর্তী মৌলসমূহ) খুব কম, কিন্তু অপেক্ষাকৃত নবীন তারায় ধাতুর পরিমাণ বেশি। সূর্যের মধ্যে অনেক ধাতু থাকার কারণেই এই গ্রহ জগৎ গঠিত হতে পেরেছে বলে ধারণা করা হয়। কারণ, ধাতুর বিবৃদ্ধি থেকেই গ্রহ গঠিত হয়।

সৌরজগৎ এর  অভ্যন্তরভাগের গ্রহসমূহ  

ভেতরের অংশে মোট চারটি গ্রহ আছে যেগুলোকে পার্থিব গ্রহ বলা হয়। এই গ্রহগুলো খুব ঘন এবং এগুলোর গাঠনিক উপাদান পাথুরে। এগুলোর উপগ্রহের সংখ্যা খুবই কম, কোন কোনটির উপগ্রহই নেই। এছাড়া এগুলোর চারদিকে কোন বলয়ও নেই। এদের গাঠনিক উপাদান মূলত বিভিন্ন খনিজ পদার্থ যাদের গলনাঙ্ক খুব বেশি। যেমন, তাদের ভূত্বক ও ম্যান্ট্‌ল সিলিকেট দ্বারা গঠিত এবং কেন্দ্র গঠিত লৌহ ও এ ধরনের অন্যান্য ধাতু দ্বারা। চারটির মধ্যে তিনটি গ্রহের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বায়ুমণ্ডল আছে। এই গ্রহ তিনটি হল শুক্র, মঙ্গল এবং পৃথিবী। আর সবগুলোরই সংঘর্ষ খাদ এবং ফাটল উপত্যকা ও আগ্নেয়গিরির মত টেকটোনিক পৃষ্ঠতলীয় কাঠামো আছে। ভেতরের দিকের গ্রহগুলোর সাথে নগণ্য গ্রহগুলোকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। যে গ্রহগুলো থেকে সূর্যের দূরত্ব পৃথিবীর চেয়ে কম সেগুলোকে নগণ্য গ্রহ বলে। বুধ এবং শুক্র নগণ্য গ্রহ।

বুধ গ্রহ

wp4047227

Image Source : Wallpaper Cave

বুধ গ্রহ সূর্যের সবচেয়ে কাছে (০.৪ এইউ) এবং এটি সৌরজগতের ক্ষুদ্রতম (০.৫৫ পার্থিব ভর) গ্রহ। এর কোন প্রাকৃতিক উপগ্রহ নেই। সংঘর্ষ খাদ ছাড়া এর একমাত্র জানা ভৌগোলিক ফিচার হচ্ছে লতিযুক্ত রিজ বা rupe। ইতিহাসের প্রথম দিকে যখন গ্রহের সংকোচন চলছিল তখন এগুলো সৃষ্টি হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। বুধের বায়ুমণ্ডল অতি নগণ্য যার প্রধান উপাদান সৌরবায়ুর প্রভাবে পৃষ্ঠ থেকে সজোরে উৎক্ষিপ্ত পরমাণু। এর তুলনামূলক বড় লৌহ কেন্দ্র এবং সরু ম্যান্ট্‌লের ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন অনুকল্পে বলা হয়েছে, একটি বড় সংঘর্ষের মাধ্যমে গ্রহটির বহিস্তর ছিন্নভিন্ন হয়ে মহাকাশে বিলীন হয়ে গেছে এবং নিকটবর্তী সূর্যের শক্তির প্রভাবে এর কোন বিবৃদ্ধিও ঘটেনি।

শুক্র গ্রহ

wp4064553

Image Source : Wallpaper Cave

শুক্র গ্রহের আকার (০.৮১৫ পার্থিব ভর) প্রায় পৃথিবীর সমান এবং সূর্য থেকে এর দূরত্ব ০.৭ এইউ। পৃথিবীর মতই এই গ্রহের ম্যান্ট্‌ল সিলিকেট দ্বারা এবং কেন্দ্রভাগ লৌহ দ্বারা গঠিত। এর বায়ুমণ্ডল বেশ পুরু এবং এর ভেতরের অংশে বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। অবশ্য গ্রহটি পৃথিবীর তুলনায় অনেক শুষ্ক এবং এর বায়ুমণ্ডল আমাদের থেকে ৯০ গুণ বেশি ঘন। এরও কোন প্রাকৃতিক উপগ্রহ নেই। পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা ৪০০° সেলসিয়াস হওয়ায় এটি সৌরজগতের সবচেয়ে উত্তপ্ত। বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে গ্রিনহাউজ গ্যাস থাকার কারণেই এর তাপমাত্রা এতো বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে সেখানে কোন ভূতাত্ত্বিক ক্রিয়া সংঘটিত হয় বলে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু উল্লেখযোগ্য পুরুত্বের বায়ুমণ্ডল ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় চৌম্বক ক্ষেত্র নেই তার। এ থেকে বোঝা যায়, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে এর বায়ুমণ্ডল নিয়মিত পূর্ণ হতে থাকে। এর ফলে চৌম্বক ক্ষেত্রের অপ্রতুলতা কাটিয়ে উঠা যায়।

পৃথিবী

03c3e5a67a235b6ad974b852ce1fc238

Image Source : Pinterest

পৃথিবী সৌরজগতের ভেতরের অংশের সবচেয়ে ঘন ও বড় গ্রহ। এটিই এ অঞ্চলের একমাত্র গ্রহ যাতে বর্তমানেও ভূতাত্ত্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলছে। এটা আমাদের জানা একমাত্র গ্রহ যাতে জীবনের অস্তিত্ব রয়েছে। এর তরল জলমণ্ডল সৌরজগতের ভেতরের অংশে অনন্য। এটিই একমাত্র গ্রহ যাতে গ্রহ টেকটোনিক পর্যবেক্ষন করা গেছে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল অন্যান্য যেকোন গ্রহ থেকে অনেক ভিন্ন। এখানে শতকরা ২১ ভাগ অক্সিজেনথাকার কারণেই জীবনের বিকাশ ঘটা সম্ভব হয়েছে। এর একটি মাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ আছে যার নাম চাঁদ বা ‘মুন’। সৌরজগতের অন্য কোন পার্থিব গ্রহের এত বড় উপগ্রহ নেই।

মঙ্গল গ্রহ

wp4646915

Image Source : Space Wallpaper

মঙ্গল গ্রহ পৃথিবী ও শুক্রের চেয়ে ছোট (.১০৭ পার্থিব ভর)। এর একটি পাতলা বায়ুমণ্ডল আছে যা মূলত কার্বন ডাই অক্সাইড দিয়ে গঠিত। পৃষ্ঠতলে প্রচুর সংখ্যক আগ্নেয়গিরি (যেমন অলিম্পাস মন্‌স) ও ফাটল উপত্যকায় (যেমন ভ্যালিস মেরিনারিস) পরিপূর্ণ। এ থেকে বোঝা যায় এর ভূতাত্ত্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া খুব বেশি দিন আগে থেমে যায়নি। লৌহ সমৃদ্ধ মাটিতে মরিচা পড়ার কারণেই গ্রহটির রং লাল। মঙ্গলের দুটি ছোট ছোট উপগ্রহ আছে যাদের নাম ডিমোস এবং ফোবোস। ধারণা করা হয়, মঙ্গল অনেক আগে কোন গ্রহাণুকে নিজ মহাকর্ষের বন্ধনে বেঁধে ফেলেছিল এবং এভাবেই উপগ্রহগুলোর সৃষ্টি হয়।

বহিঃস্থ গ্রহসমূহ

সৌরজগতের বাইরের দিকে অবস্থিত চারটি গ্রহকে গ্যাস দানব বলা হয়। মাঝেমাঝে এদেরকে জোভিয়ান গ্রহ নামেও ডাকতে দেখা যায়। সূর্যকে আবর্তনরত সকল বস্তুর সম্মিলিত ভরের শতকরা ৯৯ ভাগের জন্যই দায়ী এই বহিঃস্থ গ্রহগুলো। বৃহস্পতি ও শনি গ্রহের বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণ হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম আছে। সেখানকার বায়ুমণ্ডল মূলত এই দুটি মৌল দিয়েই গঠিত। নেপচুন ও ইউরেনাসের বায়ুমণ্ডলে বরফের পরিমাণ অনেক বেশি। এই বরফও পানি অ্যামোনিয়া বা মিথেন জমাট বেঁধে সৃষ্টি হয়। অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে এই গ্রহ দুটিকে সম্পূর্ণ নতুন একটি গ্রহ শ্রেণীতে ফেলা যায় যে শ্রেণীর নাম হবে “বরফ দানব”। চার দানবেরই নিজস্ব বলয় আছে। কিন্তু শুধু শনির বলয়ই পৃথিবী থেকে দেখা যায়। বহিঃস্থ গ্রহকে আবার উৎকৃষ্ট গ্রহের সাথে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। পৃথিবীর কক্ষপথের বাইরে অবস্থিত গ্রহগুলোকেই উৎকৃষ্ট গ্রহ নামে ডাকা হয়।

বৃহস্পতি গ্রহ

science fiction visual effects galaxy universe fresh viewpoi

Image Source : Good Fon

বৃহস্পতি গ্রহের ভর পৃথিবীর ৩১৮ গুণ এবং সবগুলো বহিঃস্থ গ্রহের সম্মলিত ভরের তুলনায়ও সে ২.৫ গুণ ভারী। গ্রহটি মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে গঠিত। তীব্র অভ্যন্তরীন তাপের কারণে এর বায়ুমণ্ডলে বেশ কিছু অর্ধ-স্থায়ী বৈশিষ্ট্যের সৃষ্টি হয় যার মধ্যে আছে মেঘের ব্যান্ড ও বিরাট লোহিত কলঙ্ক। আমাদের জানামতে এই গ্রহের ৬৭টি প্রাকৃতিক উপগ্রহ আছে। চারটি বড় বড় উপগ্রহ গ্যানিমেড, ক্যালিস্টো, আইও এবং ইউরোপা অনেকটা পার্থিব গ্রহগুলোর মত। কারণ এই উপগ্রহগুলোতে অগ্ন্যুৎপাত ও অভ্যন্তরীন তাপ বৃদ্ধির মত ভূতাত্ত্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটে। সৌরজগতের বৃহত্তম উপগ্রহ গ্যানিমেডের আকার বুধ গ্রহ থেকেও বড়।

শনি গ্রহ

wp2707951

Image Source : Wallpaper Cave

শনি গ্রহ দৃষ্টিনন্দন বলয়ের জন্য সবার কাছেই বেশ পরিচিত। বায়ুমণ্ডলের গঠনসহ বেশ কটি দিক দিয়ে এর সাথে বৃহস্পতির সাদৃশ্য আছে। অবশ্য শনি বৃহস্পতির মত অতো বড় না। এর ভর পৃথিবীর মাত্র ৯৫ গুণ। শনির ৬২টি জানা উপগ্রহের মধ্যে দুটিতে বর্তমানেও ভূতাত্ত্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলছে বলে ধারণা করা হয়। এছাড়া শনির আরও তিনটি উপগ্রহ আছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। টাইটান ও এনসেল্যাডাস উপগ্রহ দুটিতে ভূতাত্ত্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটলেও সেগুলোর মূল গাঠনিক উপাদান আসলে বরফ। টাইটান বুধের চেয়ে বড় এবং এটি সৌরজগতের একমাত্র উপগ্রহ যাতে উল্লেখযোগ্য পুরুত্বের বায়ুমণ্ডল আছে।

ইউরেনাস

uranus planets solar system high quality science wallpaper 112293 39

Image Source : Freepik

ইউরেনাসের ভর পৃথিবীর ১৪ গুণ। কিন্তু বহিঃস্থ গ্রহগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে হালকা। এই গ্রহের নিজ অক্ষের চারদিকে পরিভ্রমণ অক্ষ সূর্যের চারদিকে আবর্তন অক্ষের প্রায় সমতলে অবস্থিত। এ কারণে সেখানে কোন ঋতু পরিবর্তন ঘটে না। এর অ্যাক্সিয়াল টিল্ট ও ভূকক্ষের মধ্যবর্তী কোণ ৯০°’র চেয়ে বেশি। অন্যান্য গ্যাস দানবের চেয়ে এর কেন্দ্রের তাপমাত্রা কম বলে সে মহাকাশে তুলনামূলকভাবে কম তাপ বিকিরণ করে। এর জানা উপগ্রহের সংখ্যা ২৭টি। এর মধ্যে বড় উপগ্রহগুলি হচ্ছে টাইটানিয়া, ওবেরন, আমব্রিয়েল, এরিয়েল ও মিরান্ডা।

নেপচুন

vadim sadovski space space art planet wallpaper preview

Image Source : Wallpaper Flare

নেপচুনের আকার ইউরেনাসের চেয়ে কম হলেও ভর তার থকে বেশি। ইউরেনাসের ভর পৃথিবীর ১৪ গুণ আর নেপচুনের ভর ১৭ গুণ। এ কারণে নেপচুনের ঘনত্ব তুলনামূলক বেশি। এটি তুলনামূলক বেশি তাপ বিকিরণ করে তবে এই বিকিরণের পরিমাণ বৃহস্পতি বা শনির থেকে কম। নেপচুনের জানা উপগ্রহের সংখ্যা ১৪। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ট্রাইটন ভূতাত্ত্বিকভাবে সক্রিয়। এই উপগ্রহে উষ্ণ প্রস্রবণ ও তরল নাইট্রোজেন আছে। ট্রাইটন একমাত্র বড় উপগ্রহ যার প্রতীপ কক্ষপথ আছে। নেপচুনের কক্ষপথে বেশ কিছু ক্ষুদ্র গ্রহ আছে যেগুলোকে নেপচুন ট্রোজান বলে। এই ট্রোজানগুলো মাতৃ গ্রহের সাথে ১:১ রেজোন্যান্সে আবর্তন করে।

space sun venus mercury wallpaper preview

Image Source : Wallpaper Flare

মহাবিশ্বের যে অঞ্চলটি সৌরজগতে রুপান্তরিত হয়েছে তা প্রাক-সৌর নীহারিকা নামে পরিচিত যার ব্যাস ৭,০০০ থেকে ২০,০০০ জ্যোতির্বিজ্ঞান এককের মধ্যে।আর এর ভর ছিল সূর্যের ভরের চেয়ে সামান্য বেশি (সূর্যের ভরের ০.১ থেকে ০.০০১ অংশের মত বেশি)।যখন নীহারিকাটি ধ্বসে পড়ে তখন কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণ নীতির কারণে এর ঘূর্ণন বেগ বৃদ্ধি পায়। যেহেতু নীহারিকার মধ্যবর্তী পদার্থগুলো ঘনতর হতে থাকে সেহেতু এর মধ্যবর্তী পরমাণুসমূহের পরষ্পরের মধ্যে আরও বৃহৎ কম্পাঙ্কের সাথে সংঘর্ষ হতে থাকে। সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয় কেন্দ্রে। এর ফলে কেন্দ্রের তাপের পরিমাণ আশেপাশে চাকতির অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেক বেড়ে যায়।সংকোচনশীল নীহারিকাটির উপর অভিকর্ষ, গ্যাসীয় চাপ, চৌম্বক ক্ষেত্র এবং ঘূর্ণন একসাথে প্রভাব ফেলতে থাকে। ফলে এটি অনেকটা সমতল হয়ে যেতে থাকে এবং এক সময় একটি ভ্রূণ গ্রহীয় চাকতিতে পরিণত হয় যার ব্যাস ছিল আনুমানিক ২০০ এইউ।কেন্দ্রে সৃষ্টি হয় একটি উত্তপ্ত ও ঘন ভ্রূণ তারা।

মহান সৃষ্টিকর্তার এক অসীম রহস্যময় সৃষ্টি হল সৌরজগৎ যা নিয়ে বিজ্ঞানীদের প্রতিনিয়ত নতুন সব গ্রহ-উপগ্রহ এবং বিভিন্ন অজানা বিষয়ের খোঁজ পেতে উপচে পড়া এক প্রকার প্রতিযোগিতা লেগেই রয়েছে । আর এই সৌরজগতেরই বাসিন্দা আমরা তাই এর সকল খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানা ও জ্ঞান লাভ করে এই বিষয়ে আরো অগ্রসর হওয়া আমাদের সকলেরই একান্ত কর্তব্য যার উদাহরণস্বরূপ বিজ্ঞানীদের সফল গবেষণায় মানব জাতি আজ পৃথিবী ছেড়ে মঙ্গল গ্রহে নিজেদের স্বপ্নের জীবন বুনতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে তাই আমাদের সকলেরই উচিত আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিজ্ঞানমুখী করে আগামীর সহিংস ও ভয়াবহ দুর্যোগ থেকে রক্ষার্থে সৌরজগৎ সম্পর্কে আরো গভীর এবং বিস্তারিত জ্ঞানার্জনের দীক্ষায় সু-শিক্ষিত হয়ে মানব জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনা ।

তথ্যসুত্র : উইকিপিডিয়া

স্যাটেলাইট সম্পর্কে অজানা সব তথ্য আর্টিকেলটি পড়তে ক্লিক করুন