মহাবিশ্বের এমন কিছু তারকা বা নক্ষত্র আছে, যারা এমন শক্তিশালী মহাকর্ষ বল তৈরি করে যে এটি তার কাছাকাছি চলে আসা যেকোন বস্তুকে একেবারে টেনে নিয়ে যায়, হোক তা কোন গ্রহ, ধুমকেতু বা স্পেসক্রাফট, তা-ই ব্ল্যাক হোল। পদার্থবিজ্ঞানী জন হুইলার এর নাম দেন “ব্ল্যাক হোল“।
আমাদের গ্যালাক্সির নাম মিল্কিওয়ে বা আকাশ গঙ্গা। আকাশ গঙ্গার ঠিক মাঝখানে রয়েছে সূর্য থেকে ৪ মিলিয়ন বেশি ভরের একটি ব্ল্যাক হোল। ১৬ বছর ধরে আশে-পাশের তারামন্ডলীর গতি-বিধি পর্যবেক্ষণ করে ২০০৮ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা Sagittarius A-star নামের ব্ল্যাক হোলটি শনাক্ত করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ব্ল্যাক হোলটি কোন কিছু গলাধঃকরণ করছে না। ব্ল্যাক হোল এর ক্ষেত্রে বহুল প্রচলিত ধারণাটি হচ্ছে ব্লাক হোল সব কিছু গ্রাস করে নেয়।
ব্ল্যাক হোলের নিজস্ব ভর রয়েছে। অধিকাংশ গ্যালাক্সিই ব্ল্যাক হোলকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান থাকতে পারে। তাই বলে, ব্ল্যাক হোল গ্যালাক্সিতে থাকা নক্ষত্র, গ্রহসমূহ গিলে ফেলে না। তাই আকাশ গঙ্গার মাঝখানে বৃহৎ ব্ল্যাক হোল যদি থেকেও থাকে, তা আমাদের পৃথিবীকে কখনোই গিলে ফেলবে না। বরং সূর্য এবং অন্যান্য গ্রহগুলোর সাথে সমান দূরত্ব রেখে ঘূর্ণায়মান থাকবে। আবার ব্ল্যাক হোল সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় বৃহদায়তনের ভর সূর্যের নেই বলে সূর্যও কখনো ব্ল্যাক হোল এ পরিণত হবেনা।
ব্ল্যাক হোল গবেষণার ইতিহাস

ব্ল্যাক হোল হলো বিপুল পরিমাণ ভর বিশিষ্ট কোন বস্তু, যার মহাকর্ষের প্রভাবে আলোক তরঙ্গ পর্যন্ত পালাতে পারে না- এ ধারণা সর্বপ্রথম প্রদান করেন ভূতত্ত্ববিদ জন মিচেল । ১৭৯৬ সালে গণিতবিদ পিয়েরে সিমন ল্যাপলেস একই মতবাদ প্রদান করেন তাঁর ‘Exposition du systeme du Monde‘ বইয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণে।১৯১৬ সালে আইনস্টাইন তার “জেনারেল রিলেটিভিটি তত্ত্ব ” দিয়ে ধারনা করেন ব্ল্যাকহোল থাকা সম্ভব। আর ১৯৯৪ সালে এসে নভোচারীরা প্রমাণ করেন আসলেই ব্ল্যাকহোল আছে। এটি কোন সায়েন্স ফিকশন নয়। জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল শোয়ার্জস্কাইল্ড ১৯১৬ সালেই দেখান, যেকোন তারকা ব্ল্যাকহোলে পরিণত হতে পারে ।
ব্ল্যাক হোল এর উৎপত্তি

কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাক হোলের জন্ম ইতিহাস অনেকটা কবিতার মতো। একটি তারার মৃত্যু থেকে জন্ম নেয় একটি কৃষ্ণগহ্বর। বিজ্ঞানীদের মতে- সব চেয়ে ছোট ব্ল্যাকহোলটির জন্ম ঠিক এই মহাবিশ্বের জন্মের সময়। একটি নক্ষত্রের নির্দিষ্ট জ্বালানি নিঃশেষ হয়ে গেলে এর মৃত্যু ঘটে। যতক্ষণ পর্যন্ত এর অভ্যন্তরীণ হাইড্রোজেন গ্যাস অবশিষ্ট থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত এর ভিতরে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া চলতে থাকে। হাইড্রোজেন শেষ হয়ে গেলে এর কেন্দ্রীয় মূলবস্তু সংকুচিত হতে থাকে। এভাবে একটি তারার মৃত্যু হয়।
ব্ল্যাকহোলে রয়েছে শক্তিশালী মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র। প্রত্যেক ব্ল্যাকহোলের চারদিকে একটি সীমা আছে যেখানে একবার ঢুকলে আর বের হওয়া যায় না। এইভাবেই মহাকাশের মহাবিস্ময় হয়ে বেঁচে আছে ব্ল্যাকহোল। একে নিয়েই চলছে বিজ্ঞানের নিরন্তর চর্চা। আলোকে গিলে খাওয়া এই মহাকাশীয় দানবকে নিয়ে তাই আজও কৌতূহলের শেষ নেই।
ব্ল্যাকহোল এর প্রকারভেদ
সবচেয়ে বৃহৎ ব্ল্যাকহোলকে বলা হয় “সুপারমেসিভ”। কৃষ্ণবিবরকে ভাগ করা হয় তার মাঝে থাকা ভর, আধান, কৌণিক ভরবেগের উপর ভিত্তি করে। ভরের উপর ভিত্তি করে কৃষ্ণবিবর চার ধরনের। যেমন-
১. সুপার মেসিভ ব্ল্যাকহোল ২.ইন্টারমিডিয়েট ব্ল্যাকহোল ৩. মাইক্রো ব্ল্যাকহোল ৪. স্টেলার ব্ল্যাকহোল
ব্ল্যাকহোল নিয়ে যতরকম তথ্য
ব্ল্যাকহোল থেকে কোন কিছু বের হতে পারে না, এমনকি আলোও। এটাই চিরায়ত পদার্থবিদ্যার স্বীকার্য। তবে এই নীতিকে আর মানতে পারছেন না গবেষকরা, যাঁদের কাতারে প্রথমে আছেন ব্রিটিশ পদার্থবিদ প্রফেসর স্টিফেন হকিং । বর্তমানে এই ব্ল্যাকহোল নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তাঁর “এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম ” বইয়ে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। যা প্রমাণিত হলে যুগান্তকারী সৃষ্টি বলে প্রমাণিত হবে এই পৃথিবীতে।
পৃথিবীর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে এ পর্যন্ত যা জানতে পেরেছেন তা সামান্যই। তবে অতি সম্প্রতি যতটা তথ্য উদ্ধারে সক্ষম হয়েছেন- তা যথার্থই অভাবনীয়, সাধারণ চিন্তার বাইরে। অতএব, ব্ল্যাকহোল নিয়ে আমাদের ধারণা ভুল নয়। এর অস্তিত্ব আছে!
কম্পিউটার বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী বিস্ময়-আর্টিকেলটি পড়তে চাইলে এই বাটনে ক্লিক করুন
ব্ল্যাক হোল অদৃশ্য কেন ?

ব্ল্যাক হোলের আকর্ষণ এতই বেশী যে এর থেকে দৃশ্যমান আলো, এক্স রে, অবলোহিত রশ্মি কিছুই রক্ষা পায় না। এজন্যই ব্ল্যাক হোল আমাদের কাছে অদৃশ্য। বিজ্ঞানীরা তাই ব্ল্যাক হোল নিয়ে গবেষণা করার সময় খেয়াল করেন ব্ল্যাক হোল তার আশপাশকে কিভাবে প্রভাবিত করছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ব্ল্যাক হোল থেকে প্রায়ই উজ্জ্বল গ্যাস ও তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ফোয়ারা নিক্ষিপ্ত হয়।
সূর্য কি কোনো সময় ব্ল্যাক হোলে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আছে?
উত্তর হলো না। সূর্য কোনো সময়ই ব্ল্যাক হোলে পরিণত হবে না! কারণ সূর্য অতটা বড় না যতটা দরকার একটা তারকার ব্ল্যাক হোলে পরিণত হতে। ব্ল্যাক হোল মোটেও স্পেস বা মহাশূন্যের এতটা কাছে ভ্রমন করে না কোনো তারকা, চাঁদ বা গ্রহ কে তার শিকার বানাতে। আর পৃথিবীও কোনো দিন ব্ল্যাক হোলে গিয়ে পতিত হবে না কারণ, কোনো ব্ল্যাক হোল কিন্তু পৃথিবীর সৌরজগতের এতটা কাছাকাছি নয়। যদি সূর্যের সমান ভরের একটি ব্ল্যাক হোল সূর্যের জায়গায় প্রতিস্তাপিত হয়, তবুও নয়।

এই তারকাদের অস্বাভাবিক আকার, ভর ও ঘনত্ব থাকে, আর এর জন্যে এই সব তারকা থেকে নির্গত আলো বাইরে আসতে পারে না। সহজ ভাষায় বলতে গেলে- যখন একটি তারকার জীবনকাল শেষ হয়ে যায়, সেই মুহূর্তে তার অভিকর্ষ শক্তি এতই প্রবল হয় যে আলো ওখান থেকে বের হতে পারে না। আর এই ঘটনা তখনই ঘটে যখন একটি তারকার জীবনকাল অর্থাৎ তার নির্দিষ্ট জ্বালানি শেষ হয়ে যায়। তারকাটি পরিণত হয় ব্ল্যাকহোলে। এভাবেই একটি ব্ল্যাকহোলের সৃষ্টি হয়।