পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য ও তারারা ঘুরে বেড়ায় বিশাল এই ব্রহ্মান্ড এক সময় মানুষ এটাই বিশ্বাস করতো। এ ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন নিকোলাস কোপার্নিকাস। পরবর্তীতে গ্যালিলিও গ্যালিলি এর ভালো প্রমাণ দেন। বৃহস্পতি গ্রহের সবচেয়ে বড় চারটি চাঁদ পর্যবেক্ষণ করে তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। এ প্রমাণ বদলে দেয় মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের চিন্তাধারা। স্বাভাবিকভাবে সে ইতিহাসের অংশ হয়ে যায় বৃহস্পতি।
সপ্তম বা অষ্টম খ্রিস্টপূর্বাব্দে বৃহস্পতির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীন ব্যাবিলনীয়রা এ কাজ করেন।

এবার জেনে নেয়া যাক সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতি সম্পর্কে–
বৃহস্পতি গ্রহ ইংরেজিতে যেটি জূপিটার্ (Jupiter) নামে পরিচিত। সূর্য থেকে দূরত্বের দিক দিয়ে পঞ্চম গ্রহ হলেও আকার আয়তনের দিক দিয়ে সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতি। বৃহস্পতি ছাড়া যদি সৌর জগতের বাকি সবগুলো গ্রহের ভরকে একত্রিত করা হয় তবে বৃহস্পতির ভর তা থেকে আড়াই গুণ বেশি হবে।
বৃহস্পতি ও এর পিছনের তিনটি গ্রহ অর্থাৎ শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুনকে একসাথে গ্যাস দানব বলা হয়। এই চারটির অপর জনপ্রিয় নাম হচ্ছে জোভিয়ান গ্রহ।
পৃথিবী থেকে দেখলে বৃহস্পতির আপাত মান পাওয়া যায় ২.৮। এটি পৃথিবীর আকাশে দৃশ্যমান তৃতীয় উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। শুধু মাত্র চাঁদ এবং শুক্র গ্রহের উজ্জ্বলতা এর থেকে বেশি। অবশ্য কক্ষপথের কিছু বিন্দুতে মঙ্গল গ্রহের উজ্জ্বলতা বৃহস্পতির চেয়ে বেশি হয়ে থাকে।
সুপ্রাচীনকাল থেকেই গ্রহটি বেশ পরিচিত ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও জ্যোতিষীদের কাছে । বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রচুর পৌরাণিক কাহিনী এবং ধর্মীয় বিশ্বাসও আবর্তিত হয়েছে বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে। রোমানরা গ্রহটির নাম রেখেছিল পৌরাণিক চরিত্র জুপিটারের নামে। জুপিটার রোমান পুরাণের প্রধান দেবতা। এই নামটি প্রাক-ইন্দো-ইউরোপীয় ভোকেটিভ কাঠামো থেকে এসেছে যার অর্থ ছিল আকাশের পিতা।

বৃহস্পতি কত বড়?
বৃহস্পতি চারটি বৃহৎ গ্যাসীয় দানবের একটি, অর্থাৎ এটি প্রাথমিকভাবে কঠিন পদার্থ দ্বারা গঠিত নয়। সৌর জগতের বৃহত্তম এই গ্রহটির ব্যাস বিষুবরেখা বরাবর ১৪২,৯৮৪ কিমি। এর ঘনত্ব ১.৩২৬ গ্রাম/সেমি³ যা গ্যাসীয় দানবগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। অবশ্য পার্থিব যেকোন গ্রহ থেকে এর ঘনত্ব কম। গ্যাসীয় দানবগুলোর মধ্যে নেপচুনের ঘনত্ব সর্বোচ্চ। ১,৩০০টির বেশি পৃথিবীর জায়গা হবে এখানে!
বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডল
বৃহস্পতি একটি গ্যাসীয় গ্রহ। মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে এর বায়ুমণ্ডল গঠিত। দূর থেকে বাদামি, হলুদ, নীলচে সাদা বা গাঢ় লাল রংয়ের যেসব রেখা দেখা যায় গ্রহটির গায়ে, তা আসলে মেঘ। মেঘগুলো ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত ঘন হতে পারে। কিছু গবেষকের মতে এদের ভেতর তরল হীরা-বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
বৃহস্পতি গ্রহের প্রাথমিক উপাদান হচ্ছে হাইড্রোজেন এবং সামান্য পরিমাণ হিলিয়াম। এতে অপেক্ষাকৃত ভারী মৌলসমূহ দ্বারা গঠিত একটি কেন্দ্রও থাকতে পারে। খুব দ্রুত ঘূর্ণনের কারণে এর আকৃতি হয়েছে কমলাকৃতির গোলকের মত, বিষুবের নিকটে ক্ষুদ্র কিন্তু চোখে পড়ার মত উল্লেখযোগ্য একটি স্ফীতি অংশ রয়েছে।
বাইরের বায়ুমণ্ডল বিভিন্ন অক্ষাংশে বিভিন্ন ব্যান্ডে বিভক্ত যেগুলো বেশ সহজেই চোখে পড়ে। এ কারণে একটি ব্যান্ডের সাথে অন্য আরেকটি ব্যান্ডের সংযোগস্থলে ঝড়-ঝঞ্ঝাপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করে। এ ধরনের পরিবেশের একটি অন্যতম ফলাফল হচ্ছে মহা লাল বিন্দু (great red spot)। এটি মূলত একটি অতি শক্তিশালী ঝড় যা সপ্তদশ শতাব্দী থেকে একটানা বয়ে চলেছে বলে ধারণা করা হয়। গ্রহটিকে ঘিরে এবটি দুর্বল গ্রহীয় বলয় এবং শক্তিশালী ম্যাগনেটোস্ফিয়ার রয়েছে।
বৃহস্পতির বৃহৎ লোহিত ক্ষত

বৃহস্পতির উপরিতলের উপর একটি বড় ধরনের লালচে ক্ষত দেখা যায়। একে সাধারণত লোহিত ক্ষত (Red Spot) বলা হয়। বৃহস্পতির বিষুবরেখার ২২ ডিগ্রির দক্ষিণে একটি ঘূর্ণিঝড়ের কারণে একটি বড় আবর্তের সৃষ্টি হয়েছিল। পৃথিবীকে থেকে একটি লালচে ক্ষত মনে হয়। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই ঘূর্ণিঝড়টি চলছে। এই ঘূর্ণিঝড়টির ব্যাস পৃথিবীর দুই গুণের সমান। এর ভিতরে বায়ু প্রবাহের গতি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২৭০ মাইল। এই ঝড়ের সর্বশেষ ছবি পাওয়া গেছে নাসার জুনো প্রোব থেকে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জুলাই যে ছবি পাওয়া গেছে, তাতে এই বৃহৎ লোহিত ক্ষতকে অনেকটা পরিষ্কারভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে।
বৃহস্পতির চৌম্বকক্ষেত্র-
বৃহস্পতির নিকটবর্তী বায়ুমণ্ডল অংশে, প্রচণ্ড চাপে এর হাইড্রোজেন তরল দশায় পরিণত হয়েছে। এই তরল পদার্থ বৃহস্পতি গ্রহের উপর মহাসাগর সৃষ্টি করেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই তরল হাইড্রোজেন সাগরের তলদেশ, কোথাও কোথাও বৃহস্পতির কেন্দ্রের প্রায় অর্ধেক দূরত্বের কাছে পৌঁছেছে। হাইড্রোজেন সমুদ্রে দ্রুত ঘূর্ণনের কারণে বিদ্যুতের সৃষ্টি হয়। এবং এর দ্বারা বৃহস্পতিতে চৌম্বকক্ষেত্রে তৈরি করেছে। অবশ্য বৃহস্পতির কেন্দ্রে লোহা এবং নিকেলের পিণ্ড রয়েছে কিনা তা জানা যায় নি। ফলে এর চৌম্বক ক্ষেত্রের জন্য এই পিণ্ডই দায়ী কিনা তা জানা যায় নাই। সূর্যাভিমুখে এই চৌম্বকক্ষেত্র ১ থেকে ৩০ লক্ষ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। পক্ষান্তরে সূর্যের বিপরীত দিকে চৌম্বকক্ষেত্র ১০০ কোটি কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। উল্লেখ্য, এই চৌম্বক ক্ষেত্রে শনির কক্ষপথ পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
বৃহস্পতির ভূ-ত্বক-
বৃহস্পতি উপরিতল পুরু বরফে ঢাকা। মূলত গ্যাসীয় পদার্থ জমাট বেঁধে এই বৃহৎ গ্রহটি তৈরি হয়েছে। এই বরফের স্তরের নিচে রয়েছে প্রকৃত বৃহস্পতি।
সূর্য থেকে বৃহস্পতির দূরত্ব ও দিনকাল-
সূর্য থেকে এর গড় দূরত্ব ৭৭,৮০,০০,০০০ কিলোমিটার। নিজ অক্ষের উপর এর আবর্তন সময় প্রায় ১০ ঘণ্টা। সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে এর সময় লাগে পার্থিব ১২ বৎসর বা ৪,৩৩৩ পার্থিব দিবস।
বৃহস্পতির উপগ্রহ

সর্বশেষ তথ্য মতে, বৃহস্পতির রয়েছে ৭৯টি উপগ্রহ, যাদের মধ্যে ৪টি উপগ্রহ বৃহৎ আকৃতির। যেগুলোকে একসাথে গ্যালিলিয়ান স্যাটেলাইট বলা হয়। কারণ ১৬১০ সালে গ্যালিলিও প্রথম এই চারটি উপগ্রহ আবিষ্কার করেছিলেন।
সর্ববৃহৎ উপগ্রহ গ্যানিমেডের আকৃতি বুধ গ্রহের চেয়েও বেশি। বিভিন্ন সময় বৃহস্পতি গবেষণার উদ্দেশ্যে মহাশূন্য অভিযান প্রেরিত হয়েছে। পাইওনিয়ার এবং ভয়েজার প্রোগ্রামের মহাশূন্যযানসমূহ এর পাশ দিয়ে উড়ে গেছে। এর পরে গ্যালিলিও অরবিটার প্রেরিত হয়েছে। সবশেষে প্রেরিত অভিযানের নাম নিউ হরাইজন্স যা মূলত প্লুটোর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে। ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এটি বৃহস্পতির নিকট দিয়ে গেছে। পরবর্তীতে ইউরোপা উপগ্রহের উদ্দেশ্যে অভিযান পাঠানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
বৃহস্পতি গ্রহের বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ
প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা খালি চোখে বৃহস্পতি পর্যবেক্ষণ করে এসেছে। ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে গ্যালিলিও প্রথম টেলিস্কোপের সাহায্যে বৃহস্পতি পর্যবেক্ষণ করেন।১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে পায়োনিয়র ১০ গ্রহাণুপুঞ্জ বলয় পেরিয়ে বৃহস্পতির পাশ দিয়ে উড়ে যায়।
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ভয়েজার ১ এবং ২ বৃহস্পতির ক্ষীণ বলয় এবং নতুন কিছু উপগ্রহ শনাক্ত করে। এই সময় এর আইও উপগ্রহে আগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ধরা পড়ে। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে শুমেকার-লেভি ৯ ( Shoemaker-Levy 9) এল কিছু টুকরো বৃহস্পতির দক্ষিণ গোলার্ধের উপর পতিত হয়।
১৯৯৫-২০০৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত গ্যালিলিও নামক নভোযান বৃহস্পতি পর্যবেক্ষণ করে। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে নাসা’র New Horizons নামক নভোযান প্লুটোর উদ্দেশে যাত্রাকালে বৃহস্পতি পর্যাবেক্ষণ করে।
২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জুলাই শুমেকার-লেভি ৯ ধূমকেতুর টুকরো অংশগুলো বৃহস্পতির দক্ষিণ গোলার্ধে উপর আছড়ে পড়ে এবং তা ধ্বংস হয়ে যায়। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে বৃহস্পতির উপরিতলের রাসায়নিক বিশ্লেষণ, আবহাওয়া, অভ্যন্তরীণ গঠন এবং চৌম্বক ক্ষেত্র পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।
বৃহস্পতি নিয়ে কিছু
- বৃহস্পতির নাম নেয়া হয়েছে রোমান দেবতা জুপিটারের কাছ থেকে। মিথলজি অনুযায়ী তিনি আকাশের দেবতা।
- সৌরজগতের সবচেয়ে ছোট দিন হয় বৃহস্পতি গ্রহে। মাত্র ৯ ঘণ্টা ৫৫ মিনিটে পূর্ণ হয় দিনের হিসাব।
- বছরের হিসাবে বৃহস্পতি বেশ অলস। পৃথিবীর সময় অনুযায়ী সূর্যের চারদিকে ঘুরে আসতে গ্রহটির লেগে যায় প্রায় ১২ বছর।
- বৃহস্পতির চারদিকে খুব পাতলা তিনটি বলয় রয়েছে। এর চাঁদগুলোর সাথে ধুমকেতু বা গ্রহাণুর সংঘর্ষ থেকে ছিটকে আসা কণা থেকে বলয়গুলোর সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
- বৃহস্পতিতে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০০ মাইলেরও বেশি হতে পারে।
- বৃহস্পতির চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীর চেয়ে ১৪ – ২০ গুণ শক্তিশালী।
- কোন ঋতু নেই বৃহস্পতিতে।
- ভর আরো ৮০ গুণ বেশি হলেই বৃহস্পতি একটি নক্ষত্রে পরিণত হতো।
- বৃহস্পতির কেন্দ্রে তাপমাত্রা প্রায় ২৪,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ সূর্যের চেয়েও গরম এটি!
- রাতের আকাশে দেখতে পাওয়া সৌরজগতের গ্রহগুলোর মধ্যে বৃহস্পতি দ্বিতীয় উজ্জ্বলতম গ্রহ। প্রথম স্থানটি শুক্রের দখলে।
- পৃথিবীর অভিকর্ষের তুলনায় বৃহস্পতির অভিকর্ষ ২.৪ গুণ বেশি। অর্থাৎ এর মেঘগুলোর উপর ৫০ কেজি ওজনের কোন ব্যক্তি ভেসে থাকলে তার ওজন হবে ১২০ কেজি।