পালযুগে সাহিত্যের ভাষা হিসেবে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও শৌরসেনী অপভ্রংশ ভাষার প্রচলন ছিল। মানুষের কথ্য ভাষা ছিল মাগধী বা অপভ্রংশ । এই মাগধী বা অপভ্রংশ থেকেই বাংলা ভাষায় উৎপত্তি হয়েছে।
পাল যুগের চর্যাপদের মধ্যে প্রাচীন বাংলার নমুনা দেখা যায়। চর্যাপদগুলিতে বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের মনের ভাব লোকমুখের ভাষায় ব্যক্ত করেন। সংস্কৃত সাহিত্যে বাংলার মনীষার পরিচয় পাওয়া যায়। বৈদিক সাহিত্য, ব্যাকরণ, তর্ক বেদান্ত প্রভৃতি বিষয়ে বাঙালি পণ্ডিতরা খ্যাতি অর্জন করেন। পাল যুগের কয়েকজন বাঙালি পণ্ডিত হলেন চতুর্বেদজ্ঞ দর্ভপাণি, সন্ধ্যাকর নন্দী, জীমূতবাহন প্রমুখ। সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত ‘রামচরিত’ গ্রন্থে কৈবর্তদের সঙ্গে রামপালের যুদ্ধে বিবরণ সুনিপুণ ভাবে বর্ণিত হয়েছে। এই যুগের অপর এক বিশিষ্ট পণ্ডিত ছিলেন শ্রীধরভট্ট। দর্শন শাস্ত্রে পন্ডিত শ্রীধরভট্ট রচিত গ্রন্থ ছিল ‘ন্যায় – কদলী’।
এই গ্রন্থে ন্যায় – বৈশেষিক দর্শনের উপর গুরুত্বপূর্ন। এভাবে বাংলার প্রাচীন পাল বংশ,যারা কিনা ছিলেন খঁাটি বাঙালি তারাই বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। মধ্যযুগে মুসলমান শাসক ও অমাত্যদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এক নবজাগরণের সূচনা হয়। তাঁদের বদান্যতায় হিন্দু-মুসলমান উভয় কবিরা সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। তবে একমাত্র মুসলমান কবিরাই অতিপ্রাকৃতের বেড়াজাল ছিন্ন করে মধ্যযুগের সাহিত্যে মানবীয় কাহিনি সন্নিবেশ করেন। ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এক স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের মর্যাদা লাভ করে।ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জানা যায়, ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেন। তাঁর আগে এ অঞ্চলে বাংলা রাষ্ট্রভাষা ছিল না।এরপর দিল্লির শাসনের অধীনে বাংলা তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিলো, যার মধ্যে ছিলো উত্তর বাংলার লখনৌতি, পশ্চিম বাংলার সাতগাঁও, পূর্ব বাংলার সোনারগাঁও।
১২০৬-১৩৩৮ সন পর্যন্ত এভাবে বাংলা দিল্লির সুলতানদের অধীনে ছিলো তবে ১৩৩৮ সনে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ দিল্লির সুলতানদের বিরুদ্ধে বি্দ্রোহ ঘোষণা করেন। এভাবে বাংলাতে স্বাধীন সুলতানি যুগের সূচনা হয় যা পরবর্তী দুইশত বছর (১৩৩৮-১৫৩৮) টিকে ছিলো।
এ সময় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়। শাহী বাংলা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৩৫২ সালে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের হাত ধরে। এর মাধ্যমে বাংলা দিল্লি সালতানাত থেকে আলাদা হয়। সমগ্র বাংলা অঞ্চল, বিহার, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, নেপাল, আরাকানের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত হয় বাংলা সালতানাত। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ পুনরায় সেই হারিয়ে যাওয়া শব্দ বঙ্গকে তুলে এনেছেন।
বঙ্গ থেকেই তিনি সালতানাতের নাম দেন বাঙ্গালাহ। বাংলা ভাষা ও বাংলার জাতিসত্তা বিকাশে তাই শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের অবদান অনস্বীকার্য।এরপরে আলাউদ্দিন হুসেন শাহর অবদান ছিলো অনবদ্য।হুসেন শাহ সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। মনসামঙ্গলের কবি বিজয়গুপ্ত ও বিপ্রদাস পিপিলাই তাঁর সময় জীবিত ছিলেন। ধারণা করা হয় উভয় কবি তাঁদের মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করেছিলেন ১৪৯৫ খ্রিষ্টাব্দে। হুসেন শাহের সেনাপতি ছিলেন পরাগল খাঁ’র। তাঁর নির্দেশে কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের অনুবাদ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে পরাগল খাঁ’র পুত্র ছুটি খাঁর নির্দেশে শ্রীকর নন্দী মহাভারতের অশ্বমেধ পর্বের অনুবাদ করেন। এই সময় তাঁর দরবারে বিশিষ্ট পদকর্তা যশোরাজ খান চাকরি করতেন। তিনি ব্রজবুলিতে রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ রচনা করেন। ব্রজবুলিতে রচিত এই জাতীয় রচনার প্রাচীনতম নমুনা হিসেবে, তাঁকে এই বিষয়ের প্রথম পদকর্তা বিবেচনা করা হয়।
বাংলায় মোগল আমলে বহু মুসলিম কবির আবির্ভাব ঘটেছে। এক্ষেত্রে অধ্যাপক আলী আহমেদের ‘বাংলা কলমী পুথির বিবরণ’ ও অধ্যাপক যোতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্যের ‘বাংলার বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মুসলমান কবি’ শীর্ষ গ্রন্থটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মোগল আমলে মুসলিম পৃষ্ঠপোষকতায় বহু মুসলিম কবি-সাহিত্যিক সাহিত্য চর্চায় অগ্রসর হয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। তবে মোগল আমলে কবি-সাহিত্যিকদের সময় নির্ণয়ের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের অষ্টাদশ শতাব্দির কবি মুকিমের নাম উল্লেখ করতে হয়।
তিনি ১৭০০ থেকে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। তাঁর ‘ফায়েদুল মুকতদী’ গ্রন্থটি কবির শেষ রচনা। এটির রচনাকাল ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দ ১৭৬০ থেকে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ মধ্যে। তাঁর ‘গোলে বকাওলী’ কাব্যে কবি চট্টগ্রামের অতীত ও বর্তমান কবিদের একটা নামের তালিকা দিয়েছেন। কবির তালিকানুযায়ী সয়্যিদ সুলতান (১৫৫০-১৬৪৮) মুসলিম বাংলার মধ্যযুগীয় কবিদের মধ্যে প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ। তাঁর প্রথম কাব্য ‘শব-ই মেরাজ’ গ্রন্থের রচনাকাল ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দ এই সময় কবির বয়স ৩৫/৩৬ বছর ধরা হলে তিনি ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দ কাছাকাছি সময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কবি মুহাম্মদ খান কবি সয়্যিদ সুলতানের শিষ্য ছিলেন। মুহাম্মদ খান গুরুর আদেশে ‘কিয়ামৎ নামা’ রচনা করেন। এর রচনাকাল ১৫৬৭ শতাব্দে বা ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দ।
‘সত্য-কলি-বিবাদ’ রচনাকালে মুহাম্মদ খানের বয়স ছিল ৩৫ বছর। সে হিসেবে তাঁর জন্ম ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ। সে সময় সয়্যিদ সুলতানের বয়স ছিল ৫০ বছর অর্থাৎ ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দের পর কবি সয়্যিদ সুলতান আর অধিককাল বাঁচেননি।
কেন না, সয়্যিদ সুলতানের ‘ওফাৎ-রসূল)’ কাব্যের পরিকল্পনায় ৪ আসহাবের ও কারবালার ঘটনার বর্ণনার কথা পাওয়া সত্তে¡ও তিনি নিশ্চয়ই বার্ধক্য বশতঃ তা লিখে যেতে না পেরে তাঁর কবি শিষ্য মুহাম্মদ খানকে এই দুই বিষয়ে লিখতে আদেশ দিয়েছিলেন। কবি মুহাম্মদ খান তাঁর ‘মকতুল হুসেন’ কাব্যে হানিফার পত্র পাঠ খÐে ‘এজিদের উত্তর’ নামক অংশে মুজাফর নামক এক কবির রচনাবলে উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি সয়্যিদ সুলতানের দৌহিত্র বলে জানা যায়। কবি সয়্যিদ সুলতান কতগুলো পুস্তক রচনা করেছিলেন তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে তাঁর যেগুলো গান ও পুস্তকের পরিচয় পাওয়া গেছে।
তাঁর মধ্যে নবী বংশ, শব-ই মেরাজ, রসূল বিজয়, ওফাৎই রসূল, জয়কুম রাজার লড়াই, ইবলিস নামা, জ্ঞান চৌতিশা, জ্ঞান প্রদীপ, মারফতী গান ও পদাবলী। এসব রচনার মূল বৈশিষ্ট হলো বাংলা ভাষায় ধর্মের কথা প্রচার করা। কিন্তু গোঁড়া মুসলমানরা কবিকে মুনাফিক বলে আখ্যা দিলেন। কিন্তু কবি তাতে দমেননি।
খ্রিস্টিয় ষোড়শ শতাব্দির শেষ ও সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলাভাষায় ইসলাম ধর্মের কথা লিপিবদ্ধ করা দূষণীয় ও পাপ কাজ বলে গোঁড়া মুসলমানরা মনে করতেন। কবি আজীবন এই গোঁড়ামীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন।
এরপর কোম্পানি আমলে বাংলাভাষার প্রতি পৃষ্ঠপোষকতার তেমন উদাহরণ পাওয়া যায় না। যদিও এসময়ের প্রথম পর্বে কিছু কিছু সাহিত্য চর্চার উদাহরণ মিললেও তাতে বিদেশি বেনিয়া শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা কদাচিৎ ছিলো। এ সময় নতুন দেবদেবীদের নিয়েও কিছু মঙ্গলকাব্য রচিত হয়, যেমন: সূর্যমঙ্গল, গঙ্গামঙ্গল, শীতলামঙ্গল, লক্ষ্মীমঙ্গল, ষষ্ঠীমঙ্গল, সরস্বতীমঙ্গল প্রভৃতি। এগুলির মধ্যে দুর্গাদাস মুখার্জীর গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিণী উল্লেখযোগ্য।
আঠারো শতকে মঙ্গলকাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র। তাঁর মাধ্যমে একটা যুগের পরিণতি ঘটেছে। তাঁর প্রধান রচনা অন্নদামঙ্গল আটটি পালায় তিন খন্ডে বিভক্ত: শিবায়ন-অন্নদামঙ্গল, বিদ্যাসুন্দর-কালিকামঙ্গল ও মানসিংহ-অন্নপূর্ণামঙ্গল। খন্ডগুলির মধ্যে অন্নদা একটি ক্ষীণ যোগসূত্র রক্ষা করেন, যদিও তাঁর কৃপায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দের ভাগ্যোদয়ের ঘটনাই এ কাব্যের মূল বিষয়।
বিদ্যাসুন্দরের রসালো কাহিনীটি আঠারো শতকের ধারা ও রুচির পরিচায়ক। তাঁর আরও কয়েকটি গ্রন্থ হলো সত্যনারায়ণের পাঁচালি, রসমঞ্জরী এবং সংস্কৃতে রচিত নাগাষ্টক ও গঙ্গাষ্টক। অন্নদামঙ্গল পরবর্তীকালের কবিদের বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে। কালিকামঙ্গলের কবিরা একে ব্যাপকভাবে অনুকরণ করেন। তাছাড়া প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচনায় হ্যালহেড (১৭৭৮) ও লেবেদেফ (১৮০১) এবং বাংলা অভিধান রচনায় (১৭৯৯-১৮০২) ফরস্টার অন্নদামঙ্গলের ভাষারই উদাহরণ দিয়েছেন।
প্রকৃতপক্ষে অন্ত্যমধ্যযুগে উঁচুমানের সাহিত্য ভারতচন্দ্রের হাতেই সৃষ্টি হয়েছে। ছন্দের চমৎকার প্রয়োগ, বিশাল শব্দসম্ভার, পদরচনায় লালিত্যগুণের সঞ্চার ইত্যাদি কারণে তাঁর কাব্য অনুপম হয়ে উঠেছে।এরপর লম্বা একটা সময় বাংলাভাষার তেমন পৃষ্ঠপোষকতা ছিলো না।বরং ১৮৩৩ সালের মেকলের শিক্ষানীতিতে বাংলার শিক্ষানীতির ধারাটাই বদলে গেলো। ১৮৩৫ সালে ইংরেজি শিক্ষার একধাপ অগ্রগতি সূচিত হলেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য উপেক্ষিত থেকে গেলো। এভাবে সমগ্র বৃটিশ যুগে শাসক কতৃক বাংলার পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েই গেলো ( ১৮৫৮-১৯৪৭)। এরপরের ইতিহাস কমবেশি সকলেরই জানা।