বলকান যুদ্ধ

বলকান যুদ্ধ

তরুণ তুর্কিদলের শাসনকালে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো বলকান যুদ্ধ। এ যুদ্ধ তুর্কি শক্তির উপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। ১৯০৮ থেকে ১৯১৮ সাল পযর্ন্ত নব্য তুর্কিদল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। এ সময়ের মধ্যে তারা নানা বিপদের সম্মুখীন হয়।

অভ্যন্তরীণ দিক দিয়ে তাদেরকে প্রতিক্রিয়াশীল দলের সৃষ্ট বিপদের মোকাবিলা করতে হয় এবং বাহ্যিক দিক দিয়ে রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, ইতালি, ফ্রান্স ও বলকান শক্তিসমূহ তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক মনোভাব প্রকাশ করে। অস্ট্রিয়া বার্লিন চুক্তি ভঙ্গ করে বসনিয়া ও হারজেগোভিনা দখল করে। ইতালি তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে লিবিয়া ও ত্রিপোলি অধিকার করে। ফ্রান্স অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তর আফ্রিকার অঞ্চলসমূহ হস্তগত করে নেয়। এ ঘটনাসমূহের প্রেক্ষিতে বলকান অঞ্চলে সমস্যা আবার জটিল আকার ধারণ করে এবং শেষ পযর্ন্ত বলকান যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

বলকান যুদ্ধের প্রেক্ষাপট

আঠারো শতক থেকে তুরস্ক ইউরোপীয় রুগ্ণ ব্যক্তির বলে আখ্যায়িত হয়। তুরস্কের এ দুর্বলতার সুযোগে বলকান অঞ্চলের খ্রিস্টান প্রজাগণ স্বাধীনতা লাভের জন্য সেখানে বিদ্রোহ ও অশান্তি সৃষ্টি করে। প্রাচ্যে রাশিয়ার বলকান এলাকার প্রাধান্য বিস্তারে ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ও ইংল্যান্ড ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা তুরস্কের নিরাপত্তার বিধানে তৎপর হয়ে উঠে। তুরস্ককে কেন্দ্র করে ইউরোপীয় শক্তিবর্গের মধ্যে পরস্পর বিরোধী স্বার্থ নিয়ে যে সমস্যার উদ্ভব হয় তাই প্রাচ্য সমস্যা নামে পরিচিত।

আর এ প্রাচ্য সমস্যা থেকেই ধীরে ধীরে বলকান যুদ্ধের সৃষ্টি হয়। প্রাচ্য সমস্যা সমাধানের জন্য বহু চুক্তি সম্পাদন করা হলেও কোনো চুক্তিই সুফল বয়ে আনতে পারে নি। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৭৮ সালে বার্লিন সন্ধি দ্বারাও নিকটপ্রাচ্যের সমস্যার সমাধান হয় নি।

১৮৭৯ সাল থেকে ১৯১৩ সাল পযর্ন্ত বলকান ইউরোপীয় শক্তিবর্গের কূটনৈতিক মঞ্চে পরিণত হয়েছিল এবং বলকান জাতীয়তাবাদী আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠেছিল। বলকানের পরবর্তী ইতিহাসকে বার্লিন সন্ধির শর্তাবলি ভঙ্গের ও তজ্জনিত আন্তর্জাতিক জটিলতার ইতিহাস বলা যায়। তুর্কিদের শাসনে ম্যাসিডোনিয়ার খ্রিস্টানগণ সন্তুষ্ট ছিল না।

ম্যাসিডোনিয়ার খ্রিস্টানদের অভাব-অভিযোগের অজুহাতে ইউরোপীয় শক্তিগুলো প্রায়ই তাদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতো। ম্যাসিডোনিয়ার বৈদেশিক আধিপত্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তরুণ তুর্কিদল বলকান অঞ্চলে তুরস্কীকরণ নীতি অনুসরণ করে। ফলে খ্রিস্টানদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। এছাড়াও রাশিয়ার নীতিও বলকান যুদ্ধের জন্য দায়ী ছিল। রাশিয়া তার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বলকান রাষ্ট্রগুলোকে যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। স্বীয় স্বার্থের জন্য রাশিয়া বলকান রাষ্ট্রগুলোকে সব সময় তুরস্কের বিরেুদ্ধে উস্কানি দিত। এছাড়াও অস্ট্রিয়া কর্তৃক বলকানে প্রাধান্য বিস্তার, জার্মানির প্রাধান্য, ইতালির প্রাধান্য বিস্তার সব মিলিয়ে ঐ সময় এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল যে যুদ্ধ ছিল অনিবার্য্য।

বলকান রাষ্ট্রসমূহের যুদ্ধ ইউরোপীয় ইতিহাসে একট স্মরণীয় ঘটনা। বার্লিন চুক্তির মাধ্যমে ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও ইতালি বলকান রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দেয়। বলকান অঞ্চল থেকে ইউরোপীয়রা রাশিয়াকে অপসারণ করতে গিয়ে সেখানে একাধিক রাষ্ট্রকে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেয়। ইতোমধ্যে বলকান অঞ্চলের অধিকাংশ রাষ্ট্র স্বাধীন হওয়ায় তুরস্কের অধীনস্থ ম্যাসিডোনিয়া স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করতে থাকে। ফলে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়।