সৌরজগতের দ্বিতীয় গ্রহ শুক্র( দূরত্ব ১০ কোটি ৮ লক্ষ কিলোমিটার)। পৃথিবীর সাথে শুক্রের অনেক বিশিষ্ট্যের মিল থাকায় এটি পৃথিবীর যমজ বা পৃথিবীর বোন গ্রহ বলে পরিচিত।শুক্র গ্রহকে আমরা সকালের আকাশে শুকতারা এবং সন্ধ্যার আকাশে সন্ধ্যাতারা হিসেবে দেখে থাকি।
নামকরণ
শুক্র গ্রহ এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Venus(ভেনাস)।শুক্রের বিশেষণ হিসেবে Venusian(ভেনুশিয়ান) শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এর লাতিন নামকরণ করা হয়েছে রোমান প্রেমের দেবী ভিনাসের নামানুসারে।শুক্রের বাংলা নামকরণ করা হয়েছে অসুরদের রক্ষক এবং গুরু শুক্রাচার্য এর নামানুসারে। অনেক বিজ্ঞানী শুক্রের বিশেষণ হিসেবে ‘সিথারিয়ান’ শব্দটি ব্যবহার করেন। সিথারিয়ান শব্দটি এসেছে গ্রিক পুরাণে উল্লেখিত দেবীর নাম ‘সিথারিয়া’ থেকে। শুক্রের আরও বেশ কয়েকটি বিশেষণ রয়েছে; ভেনারিয়ান( Venarian,Veneren), ভেনারান( veneran) ইত্যাদি। জাপানি, চৈনিক, কোরিয় ও ভিয়েতনামিজ সংস্কৃতিতে শুক্রকে বলা হয় ‘ধাতব তারা’।‘ ধাতব তারা’ পৃথিবী সৃষ্টিকারী পাঁচটি মৌলিক উপাদানের নাম থেকে উৎসারিত।

ভূপৃষ্ঠ
শুক্রের পৃষ্ঠ অনেকটাই পৃথিবীর মত। শুক্র গ্রহের পৃষ্ঠে অসংখ্য খাদ রয়েছে। এই খাদ্গুলো মূলত সৃষ্টি হয়েছে উল্কাপাতের কারণে।বেশিরভাগ খাদের প্রস্থই ১ দশমিক ২ কিলোমিটার।শুক্রের ভূত্বক পৃথিবীর তুলনায় অধিক পাথুরে। মনে করা হয়ে থাকে, ৩০ থেকে ৪০ কোটি বছর আগে আগ্নেয়গিরির কারণে নতুন ভুপৃষ্টের সৃষ্টি হয়েছিল। এই গ্রহে সৌরজগতের অন্য সাতটি গ্রহের তুলনায় আগ্নেয়গিরির পরিমাণ বেশি। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা শুক্রের পৃষ্ঠে ১৬০০ টিরও বেশি আগ্নেয়গিরির খোঁজ পেয়েছেন। তবে বর্তমানে সবগুলো আগ্নেয়গিরিই মৃত, প্রায় ৩০ থেকে ৫০ কোটি বছর পূর্বেই আগ্নেয়গিরির উৎপাত বন্ধ হয়ে গেছে।
শুক্রের কোনো চৌম্বক ক্ষেত্র নেই, যদিও এর কেন্দ্রীয় অংশে লৌহ রয়েছে। এই লৌহ চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরির জন্যে যথেষ্ট নয়।
শুক্রের দুটি বড় ধরণের উচ্চভুমি রয়েছে। প্রথমটির আকার প্রায় অস্ট্রেলিয়া মহাকাশের সমান যার নাম ’ইশতার টেরা’(Istar Terra)। পরেরটির নাম ‘এ্যাফ্রোদাইতে টেরা’( Aphrodite Terra)। এটির আয়তন প্রায় দক্ষিণ আমেরিকার সমান।
শুক্র বছর
জোয়ার বল , ঘর্ষণ ও পুরু পরিবেশের কারণে শুক্রের প্রদীপ গতি অনেক ধীর। একবার সম্পূর্ণ রূপে নিজ কক্ষপথ পরিভ্রমণ করতে শুক্রের সময় লাগে ২২৫ দিন। এটি পূর্ব থেকে পশ্চিমে ঘুরে। কিন্তু সৌরজগতের অধিকাংশ গ্রহই পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘুরে। শুক্রের আকাশে সূর্যের দেখা মিললে তা পশ্চিমে উদিত হতো এবং পূর্বে অস্ত যেত।
একটি শুক্র বছরের স্থায়িত্বকাল হচ্ছে এক দশমিক নয় দুই(১.৯২) শুক্রীয় দিবস। এর আহ্নিক গতি ১১৬.৭৫ দিনের সমান।
শুক্রের ব্যাস ১২,১০৪ কিলোমিটার এবং ঘনত্ব ৫.০৬। এর মুক্তিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ৬ দশমিক ৫ মাইল।

শুক্রের আবহমণ্ডল
শুক্রের আবহমণ্ডলের অধিকাংশই কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস। শুক্রে মাত্র শূন্য দশমিক চার ভাগ অক্সিজেন গ্যাস রয়েছে। এছাড়াও এই গ্রহে কিছু নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া এবং অতি সামান্য পরিমান জলীয়বাষ্পের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর বায়ুমণ্ডল তাপ ধরে রাখে এমনকি ৪৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরেও উঠে থাকে। এখন অবধি যেসব মহাকাশযান শুক্রে অবতরণ করেছে তীব্র তাপের কারণে তাদের একটিও ২ ঘন্টার বেশি অবস্থান করতে পারে নি।
কক্ষপথ

শুক্র গ্রহের কক্ষপথ গোলাকার। কিন্তু সৌরজগতের অন্য সব গ্রহের কক্ষপথ উপবৃত্তাকার। শুক্রের উপকেন্দ্রিকতা শতকরা এক ভাগেরও কম। শুক্রকে কেবল সূর্যোদয়ের কয়েক ঘন্টা আগে এবং সূর্যাস্তের কয়েক ঘন্টা পরে দেখা যায়। কারণ, সূর্য হতে পৃথিবীর দূরত্ব পৃথিবীর চেয়ে কম হওয়ায় পৃথিবীর যে দিক থেকে সূর্য উদিত হয়,শুক্রও প্রায় একই দিক থেকে উদিত হয়। তবে যখন এই গ্রহটি তার উজ্জ্বলতম অবস্থায় থাকে তখন দিনের বেলাতেও এটির দেখা মেলে। অন্ধকার আকাশে শুক্র গ্রহকে অনেকটা তারার মত জ্বলজ্বল করতে দেখা যায়।
শুক্রের পরপর দুটি সর্বোচ্চ প্রতনের মধ্যবর্তী চক্রের সময়কাল ৫৮৪ দিন। শুক্র গ্রহ প্রতি ৮ বছর পরপর ( অধিবর্ষের ২ দিন বাদ দিয়ে) তার আগের অবস্থানে ফিরে আসে। এই সময়কালটি ৯৯ টি চন্দ্রমাসের সমান।
ট্রানজিট
ট্রানজিট হচ্ছে নিয়মিত বিরতিতে শুক্র গ্রহকে পৃথিবী এবং সূর্যের মধ্যে অতিবাহিত হতে দেখা যাওয়া। ১৬৩১, ১৬৩৯, ১৭৬১,১৮৭৪ এবং ১৮৮২ সালে ট্রানজিট দেখা গিয়েছিল। এই শতাব্দীর প্রথম ট্রানজিট হয়েছিল ২০০৪ সালের ৮ই জুন। এরপর হয় ২০১২ সালের ৬ই জুন।ধারণা করা হয়, পরবর্তী ট্রানজিট হবে ২১১৭ সালের ১১ই ডিসেম্বর।

শুক্রাভিযান
শুক্র গ্রহের সম্পর্কে জানার জন্যে বিজ্ঞানীরা অনেক মহাকাশযান পাঠিয়েছে মহাকাশে। এসব মহাকাশযানের মধ্যে পাইওনিয়ার , ভেনাস-১ , ভেনাস-১১ থেকে ১৪ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পাইওনিয়ার মহাকাশযানের তোলা ছবি থেকে শুক্রের বিশাল পাহাড়, সমতল্ভূমি ও অনেক আগ্নেয়গিরির সন্ধান পেয়েছে বিজ্ঞানীরা। এই মহাকাশযানের সূক্ষ্ম জরিপের ফলে শুক্র গ্রহের একটা মানচিত্র তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। এছাড়া ভেনাস-১৪ ও ১৫ শুক্র গ্রহে ১৯৭৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর অবতরণ করে। এই মহাকাশযান শুক্রের রঙিন ছবি পাঠিয়েছে পৃথিবীতে। ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে ভেনাস-৩ শুক্রের উপরিভাগে বিধ্বস্ত হয়।

ভীষণভাবে জীবিত গ্রহ শুক্র
শুক্র গ্রহকে আগে ‘ভূতাত্ত্বিকভাবে মৃত’ ভাবা হতো। কিন্তু, সম্প্রতি নতুন একটি গবেষণায় শুক্রকে ‘ভীষণভাবে জীবিত গ্রহ’ বলেছেন বিজ্ঞানীরা। মঙ্গলের মতন শুক্রও একসময় প্রাণের বিকাশের উপযোগী ছিল বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। এনভিশন প্রোজেক্টের প্রধান গবেষক ড. রিচার্ড গেইল মনে করছেন, শুক্র গ্রহ তার পৃষ্ঠতলে অন্ততপক্ষে একশ মিলিয়ন বছর ধরে পানি রাখতে পারতো। এছাড়াও তিনি মনে করছেন বিলিয়ন বছর ধরে শুক্রের বুকে সাগর থাকাও সম্ভব। শুক্রকে ‘টফি গ্রহ’ অর্থাৎ এর বাহ্যিক স্তরটি খুবই পাতলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই তত্ত্বটি নিয়েও কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের ধারণা শুক্র গ্রহের অনেক স্থানেই এর উপরের স্তরটি অনেক পুরু হতে পারে।
শুক্রে ফসফিন গ্যাসের অস্তিত্ব
মহাবিশ্বে পৃথিবীর মত অন্য কোনো গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি না এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মানুষ প্রথমেই মঙ্গল গ্রহের কথাই ভাবে। কিন্তু পৃথিবীর সঙ্গে তুলনায় ৯৬ শতাংশ বসবাসের অযোগ্য গ্রহ শুক্রের মেঘে ফসফিন গ্যাসের অস্তিত্ব পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ফসফিন গ্যাসের অণু তৈরি হয় একটি ফসফরাস পরমাণু আর তিনটি হাইড্রোজেন পরমাণুর সমন্বয়ে।
পৃথিবীর কিছু ব্যাকটেরিয়া প্রাকৃতিকভাবে ফসফরাসের সঙ্গে হাইড্রোজেনের মিলন ঘটিয়ে এই গ্যাস তৈরি করে। শুক্রের পৃষ্ঠের ৫০ কিলোমিটার উপরে মেঘের মধ্যে এই ফসফিন গ্যাসের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। যুক্তরাষ্ট্রের কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জেন গ্রাভস এবং তার সহকর্মীরা এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন। ‘নেচার অ্যাস্ট্রোনমি’ সাময়িকীতে শুক্রের ফসফিন সম্পর্কে একটি পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেছেন। সেখানে তারা দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে এই গ্যাসটি হয়তো জীবন বা প্রাণ তৈরির একটি প্রাকৃতিক, অজৈব উৎস হতে পারে।

ওয়াই দ্বীপে স্থাপিত ‘জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল’ টেলিস্কোপ দিয়ে শুক্রের মেঘপুঞ্জে ফসফিন প্রথম শনাক্ত করে অধ্যাপক গ্রেভেসের দল। এরপর চিলির’ আতকামা লার্জ মিলিমিটার রেডিও’ দিয়ে তা নিশ্চিত হন।
শুক্র গ্রহের পরিবেশ সম্পর্কে তাদের গবেষণায় যা জানা গেছে তাতে সেখানে ফসফিন থাকার কোনো জৈবিক ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। কিন্তু সেখানে যে পরিমান গ্যাসের উপস্থিতি শনাক্ত করা গেছে তা বিবেচনায় রাখলে জীবন্ত কোন উৎস থাকার কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।