পারস্যের রাজনৈতিক ইতিহাসে আঠারো শতকের শেষ দিকে কাজার বংশের উত্থান একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৭৯৪ সালে তেহরানে আগা মোহাম্মদ খানের অভিষেকের মধ্য দিয়ে ইরানে কাজার বংশের রাজত্বের সূচনা হয়। কাজার বংশপরম্পরায় যে কয়জন শাহ ইরানের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে রাজত্ব করেন তাদের মধ্যে নাসিরউদ্দিন শাহ অন্যতম।
নাসিরউদ্দিন শাহের পরিচয়
নাসিরউদ্দিন শাহ ছিলেন ইরানের কাজার বংশের বতুর্থ শাসক। তিনি ১৮৩১ সালের ১৬ জুলাই তাব্রিজে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মোহাম্মদ শাহ কাজার এবং মাতার নাম মালেক জাহান খানম। পিতা মোহাম্মদ শাহ কাজারের মৃত্যুর পর তিনি ১৮৪৮ সালে ১৭ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেন। মির্জা তাকি খান সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন এবং প্রধান প্রশাসক বা ‘আমির-ই-কবির’ হিসেবে প্রশাসনের সর্বপ্রকার দায়িত্ব পালন করেন। তাকি খান অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে সংস্কার সাধন করেন। কিন্তু তিনি বাবী সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু সৈয়দ মোহাম্মদ আলীকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিলে সমগ্র ইরানে বিদ্রোহের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে।
এজন্য নাসিরউদ্দিন শাহ তাকি খানকে ১৮৫১ সালে পদচ্যুত করতে বাধ্য হন। নাসিরউদ্দিন শাহ তাকি খানের মৃত্যুর পর শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন। এরপর তাকি খানের স্থলাভিষিক্ত হন সদর-ই-আযম মির্জা আগা খান নূরী। নাসিরউদ্দিন শাহের আমলে এই সদর ই-আজমের কূটনৈতিক শততা, কপটতায় রুশ ও ব্রিটিশ প্রতিনিধিগণ তার উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। উপরন্তু হিরাত আক্রমণ করে ঘৃণ্য প্যারিস চুক্তির ফলে ইরানের মর্যাদা হানি হয় এবং উপসাগরীয় অঞ্চলে বিদেশি প্রভাব বিস্তার লাভ করে। ফলে সদর-ই-আযমের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায় এবং শাহ ১৮৫৭ সালে তাকে পদচ্যুত করে সমস্ত ক্ষমতা স্বীয় হস্তে গ্রহণ করেন। তিনিই কাজার শাসকদের মধ্যে প্রথম পাশ্চাত্য দেশসমূহ পর্য্যটন করেন। তিনি লন্ডন, প্যারিস, সেন্ট পিটার্সবার্গ, মিউনিক ও অন্যান্য উন্নত পাশ্চাত্য দেশসমূহ পরিভ্রমণ করেন।
তিনি ইরানের শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণের জন্য বিভিন্ন স্কুল ও বিজ্ঞান ভবন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৫১ সালে বিজ্ঞান ভবন বা ‘দারুল ফুনুন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ইরানিগণ পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান, ভাষা ও সাহিত্যের সংস্পর্শে আসতে পারে। তার শাসনামলে টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা চালু হয়। তাছাড়া তার শাসনামলে রেলপথ, হাসপাতাল এবং ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। নাসিরউদ্দিন শাহ সুদীর্ঘ ৪৮ বছর শাসনকার্য্য পরিচালনা করে ১৮৯৬ সালে মির্জা মোহাম্মদ রেজা নামের এক মোল্লার গুলিতে নিহত হন।
কাজার বংশের যে কয়জন শাসক পারস্যের ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন তাদের মধ্যে নাসিরউদ্দিন শাহ অন্যতম। তিনি ছিলেন একজন যোগ্য, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ শাসক। তিনি তার সুদীর্ঘ ৪৮ বছরের শাসনকালে সাম্রাজ্যে বিভিন্ন জনহিতকর কার্যাবলি সম্পন্ন করেন।