ছয়দফা আন্দোলন

ছয়দফা আন্দোলন

বিভিন্ন দেশের যেকোনো কালের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, কোনো একটি বিশেষ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটই একটি দেশের রাজনৈতিক ধারাকে পরিবর্তন করে যার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠে রাজনৈতিক চিন্তাধারা, নেতৃত্ব ও নীতিমালা। তদ্রূপ বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ৬ দফা ছিল এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যার আওতায় রয়েছে অবিভক্ত পাকিস্তানের ২৪ বছরের জীবনকাল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

ছয় দফা আন্দোলন

পূর্ব পাকিস্তানকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সুদীর্ঘ ২৪ বছর পর্যায়ক্রমে শোষণ করে। তাই পশ্চিম পাকিস্তানের এ পরিকল্পিত শোষণের হিংস্র দাবানল থেকে মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ৬ দফা দাবি সংবলিত যে প্রস্তাব পেশ করেন তা ইতিহাসে ছয় দফা আন্দোলন নামে পরিচিত।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ববাংলার জনসাধারণের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ঘৃণ্য প্রয়াসে লিপ্ত হয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর পরই পূর্ববাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন আদায়ের লক্ষ্যকে সামনে রেখে ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী লাহোরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের বিরোধী দলসমূহের এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান যে ৬ দফাভিত্তিক দাবি উপস্থাপন করেন তাই ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচি বা আন্দোলন নামে খ্যাত। 

ছয় দফা কর্মসূচি:

১. প্রথম দফা- শাসনতান্ত্রিক কাঠামো:

ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানে প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার হবে সংসদীয় পদ্ধতির। সর্বজনীন ভোটধিকারের ভিত্তিতে সকল প্রাপ্তবয়স্কের ভোটে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভাগুলো গঠিত হবে।

২. দ্বিতীয় দফা- কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা:

যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের হাতে থাকবে কেবল দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়সমূহ। অবশিষ্ট বিষয় প্রদেশ বা অঙ্গ রাজ্যগুলোর পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে।  

৩. তৃতীয় দফা- মৃদ্রা ও অর্থ বিষয়ক ক্ষমতাঃ

দেশের দুই অঞ্চলের জন্য দু’টি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে অথবা দেশের দুই অঞ্চলে পাচার হতে না পারে।

৪. চতুর্থ দফা- রাজস্ব কর ও শুল্ক বিষয়ক ক্ষমতাঃ

সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, করর্ধায এবং আদায়ের ক্ষমতা প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য আদায়কৃত অর্থের একটা অংশ কেন্দ্রীয় সরকার পাবে।

৫. পঞ্চম দফা- বৈদেশিক মুদ্রা ও বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতাঃ

বৈদেশিক মুদ্রার উপর প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যগুলোর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্য সম্পর্কে প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যের সরকারগুলো আলাপ-আলোচনা ও চুক্তি করতে পারবে।

৬. ষষ্ঠ দফা- অবৈতনিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতাঃ

আঞ্চলিক সংহতি ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার কাযর্কর ব্যবস্থা হিসেবে প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যগুলো আধা-সামরিক বাহিনী’ বা মিলিশিয়া রাখতে পারবে।

পাকিস্তানি শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবির পটভূমিতে আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এ দাবি ছিল সমগ্র বাংলার জনগণের প্রাণের দাবি। পূর্ববাংলার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার এক মূর্ত প্রতীক।