বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী বিস্ময় ও আধুনিকতম আবিষ্কার হল কম্পিউটার । বর্তমানে এটি ছাড়া আমাদের যেকোন কর্মসংস্থানের কাজ সম্পন্ন করার চিন্তা আমরা আজ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারি না । সময়ের সাথে সাথে কম্পিউটার বিজ্ঞান প্রযুক্তি তাল মিলিয়ে আজ আমাদের দৈনন্দিন চাহিদার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছে। যেখানে সর্বপ্রথম কম্পিউটার শুধুমাত্র একটি গণনাকারী যন্ত্র হিসেবে আবিষ্কৃত হয়েছিল সেই পর্যায় থেকে আজ কম্পিউটারের মাধ্যমে আমরা বর্তমানে আমাদের সকল দৈনন্দিন পেশাদারি কার্যাবলির চাহিদা মেটাতে সক্ষম প্রায় ।
সময় যত এগোচ্ছে পৃথিবী যেন ততই ছোট হয়ে আসছে যার অন্যতম রূপ বৈশ্বিক গ্রাম । পৃথিবী যেন আজ একটি ছোট গ্রামে পরিণত হয়েছে । যেখানে সবাই তাঁর নিজ নিজ প্রয়োজনীয় কাজ বাসায় বসে করতে পারছে একমাত্র ইন্টারনেটের আদলে কম্পিউটার ব্যবহারের মাধ্যমে ।একবিংশ শতাব্দীতে এসে কম্পিউটারের সংখ্যার অধিক সংখ্যায় মোবাইল ফোন ব্যবহার হলেও রাজকীয় সিংহাসন আদৌ কম্পিউটার তাঁর নিজ দখলে রেখেছে । কম্পিউটারের ন্যায় গুটিকয়েক নয় বরং অধিকাংশ কাজ আজ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হলেও কাজের মান ,কর্মীর পছন্দ ও কাজ করার ক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্য ভোগের ব্যাপারটি কম্পিউটার শতবর্ষ ধরে কায়েম রেখেছে ।
অত্যাধুনিক কম্পিউটারের যুগে ঘরে ঘরে কম্পিউটার এসে গেছে, অনলাইন কাজ থেকে ডাটা এন্ট্রি সবই হচ্ছে কম্পিউটার নামের এই যন্ত্রটির মাধ্যমে,আধুনিক কম্পিউটারের এই চেহারা কিন্তু একদিনে আসেনি, যুগ যুগ ধরে বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে এই যন্ত্র। ল্যাটিন ‘compute’ শব্দ থেকে ‘computer’ শব্দটির উৎপত্তি। আভিধানিক অর্থে কম্পিউটার হলো এক ধরনের গণক যন্ত্র। কিন্তু এখন কম্পিউটারকে কেবল গণনাকারী বলা চলে না। এখন কম্পিউটার বলতে একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্রের ধারণা দেয় যা অগণিত তথ্য বা উপাত্ত গ্রহণ করে অত্যন্ত দ্রুত ও নির্ভুলভাবে সংরক্ষণ, গণনা, বিশ্লেষণ ইত্যাদি করতে পারে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।
প্রাচীন কালে যখন লিখিত সংখ্যার উৎপত্তি হয়নি তখন গণনার জন্য মানুষ হাতের আঙ্গুল ব্যবহার করতো। কিন্তু ১০ এর বেশি গণনার দরকার হওয়ার পর থেকে মানুষ নানা রকম নুড়ি পাথর, পশুর হাড়, গাছের বাকল প্রভৃতি ব্যবহার করতে শুরু করে। গণনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রাচীন যে সরঞ্জাম পাওয়া যায় তা হল খাঁজযুক্ত হাড়। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪,০০০ বছর পূর্বে এসব হাড়ের ব্যবহার পাওয়া যায় দক্ষিণ আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে। এছাড়া খ্রিষ্টপূর্ব ৩০,০০০ বছর পূর্বে ইসাঙ্গো হাড় নামক আরেক ধরনের গণনার সরঞ্জাম পাওয়া যায়। এই হাড়ের গায়ে কয়েকটি খাঁজের সেটের মত প্যাটার্ন দেখা যেত। অনেকটা ট্যালির মত। অনেকের ধারণা মতে এগুলো চন্দ্রভিত্তিক দিনপঞ্জি হিসেবে ব্যবহার হতো। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে গণনার প্রয়োজন সকল ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
সর্বপ্রাচীন কম্পিউটার অ্যাবাকাস

Image source: Pinterest
কম্পিউটারের ইতিহাস শুরু হয়েছিল অ্যাবাকাস এর উৎপত্তির মাধ্যমে। ইতিহাসবিদদের মতে খ্রিস্টপূর্ব ২৭০০-২৩০০ অব্দে সুমেরীয় বা মেসোপটেমীয় সভ্যতায় অ্যাবাকাস প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল। সেই অ্যাবাকাস গুলোতে অনেকগুলো কলাম ক্রমান্বয়ে সজ্জিত থাকতো যার মাধ্যমে বিভিন্ন মান প্রকাশিত হতো। একটি আয়তাকার ফ্রেমে অনেকগুলো সমান্তরাল বা উলম্ব সারিতে প্লাস্টিক বা কাঠের পুঁতি বসিয়ে অ্যাবাকাস তৈরী করা হয়েছিলো। সাত থেকে দশটি পুঁতি বসানো থাকতো প্রতি সারিতে। এগুলো গণনা করে যোগ বা বিয়োগ করা হতো। অনেক প্রাচীন সভ্যতায় গাণিতিক হিসাবের প্রয়োজনে অ্যাবাকাস ব্যবহার করা হতো। চীন, জাপান, ভারত সহ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এর ব্যাপক প্রচলন ছিল।প্রাচীন যুগের এ্যাবাকাস থেকে কম্পিউটারের প্রথম চিন্তার সূত্রপাত।
প্যাসকেলের গণনাযন্ত্র

Image source: Wikipedia
১৬৪২ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী ব্লেইজ প্যাসকেল সর্বপ্রথম যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর আবিষ্কার করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর। তিনি গিয়ারের সাহায্যে যোগ বিয়োগ করার পদ্ধতি চালু করেন। ১৬৭২ সালে জার্মান গণিতবিদ গটফ্রাইড উইলহেলম লিবনিজ প্যাসকেলের যন্ত্রের ভিত্তিতে রেকোনার (ডিজিটাল সংখ্যা গনকযন্ত্র) আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্রের কাজ সম্পন্ন হয় ১৬৯৪ সালে। তার এই যন্ত্র যোগ বিয়োগের পাশাপাশি গুণ, ভাগ এমনকি বর্গমূলও করতে পারতো।
ডিফারেন্স ও অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন

Image source: Computer History Museum
উনিশ শতকের শুরুর দিকে চার্লস ব্যাবেজ ডিফারেন্স ইঞ্জিন নামক একটি যন্ত্র নির্মাণ করেন। ১৮১০ সালে প্রথম যান্ত্রিক উপায়ে গণনা করার জন্য যন্ত্র উদ্ভাবনের কথা ভাবেন তিনি। প্রথমে ৮ দশমিক ঘর পর্যন্ত এবং পরবর্তীকালে ২০ দশমিক সংখ্যা পর্যন্ত সংখ্যা গণনার যন্ত্র তৈরি করেন তিনি। ১৮৩৭ সালে তিনি অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন বা বিশ্লেষণ ধর্মী যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্রের গাণিতিক হিসাব করার ক্ষমতা ছাড়াও যান্ত্রিক স্মৃতিশক্তি, যুক্তি নির্ভর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ছিল। এই যন্ত্র পাঞ্চ কার্ড দিয়ে চালিত হতো এবং ক্রমানুযায়ী একের পর এক কার্য সম্পাদন করতে পারতো। যন্ত্রটি আধুনিক কম্পিউটারেরই প্রথম সংস্করণ ছিল। তাই, চার্লস ব্যাবেজকে কম্পিউটিং এর অন্যতম পথিকৃৎ বলে মনে করা হয়।

Image source: SlideShare
কবি লর্ড বাইরনের মেয়ে এডা বাইরন চার্লস ব্যাবেজের অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন প্রকল্পে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এই সময় তিনি সংখ্যা গণনা করার অ্যালগরিদম বা ধাপে ধাপে সমাধান করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। কম্পিউটারের সর্বপ্রথম এলগরিদম এটিই ছিল। আধুনিক কম্পিউটারে থাকা অংশ গুলির সঙ্গে চার্লস ব্যাবেজের এনালাইটিক্যাল ইঞ্জিনের অংশগুলির মিল আছে। এই কারনেই চার্লস ব্যাবেজকে কম্পিউটারের জনক বলা হয়ে থাকে।
নেপিয়ার বোন
স্কটল্যান্ডেরর গণিতবিদ জন নেপিয়ার গণনার কাজে এক ধরণের দণ্ড ব্যবহার করেন। এই দণ্ড নেপিয়ারের অস্থি বা নেপিয়ার বোন নামে পরিচিত। ভিলহেম স্কিকার্ড নামক জার্মানির একজন প্রফেসর ১৬২৪ সালে নতুন ধরনের একটি ক্যালকুলেটিং মেশিন তৈরি করেন। তার মেশিনটি ১৭ শতকের ডিরেক্ট এন্ট্রি ক্যালকুলেটিং মেশিন গুলোর মধ্যে একদম প্রথম দিকের।

Image source: Pinterest
অ্যান্টিকিথেরা মেকানিজম
মানব সভ্যতার ইতিহাসের প্রথম অ্যানালগ কম্পিউটার বলা হয় অ্যান্টিকিথেরা মেকানিজম কে। প্রাচীন গ্রীসের লোকেরা গ্রহ- নক্ষত্রের সূক্ষ্ম হিসাব রাখতে অ্যান্টিকিথেরা মেকানিজম নামক যন্ত্রটি ব্যবহার করতো। দক্ষিণ গ্রীসের সমুদ্র উপকূলে ডুবে থাকা একটি রোমান জাহাজ থেকে যন্ত্রটি উদ্ধার করা হয়েছিল। ১৯০১ সালে উদ্ধার করা হলেও পরবর্তী কয়েক দশক গবেষকরা যন্ত্রটির ব্যবহার সম্পর্কে তেমন কিছুই বলতে পারে নি। ১৯৫৯ সালে ডেরেক প্রেইস নামক ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ এই যন্ত্রটিকে নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয়ের যন্ত্র বলেন। যন্ত্রটির তিনটি ডায়াল ছিল। ৩৬৫ দিনের ক্যালেন্ডার, ২৩৫ মাসের মেটোনিক সার্কেল এবং সারোস সার্কেলে গ্রহের অবস্থান জানা যেত ডায়াল গুলোর মাধ্যমে। বর্তমানে নৌ জাহাজে এই কাজগুলো কম্পিউটারের সাহায্যে করা হয়। যন্ত্রটির কার্যক্রম ঘড়ির কার্যক্রমের সাথেও মিল ছিল। যন্ত্রটির সাথে L আকৃতির একটি হাতল লাগানো ছিল। এর সাহায্যে একটি তারিখ নির্দিষ্ট করে দিলে সঙ্গেসঙ্গে যন্ত্রটি সেই তারিখের গ্রহ- নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয় করে ফেলতে পারতো। এই যন্ত্রটির সাহায্যে বিভিন্ন দিনক্ষণের হিসাব যেমনঃ প্রাচীন অলিম্পিক গেমসের সময়ের হিসাবও রাখা হতো। ব্রোঞ্জ, পাথর আর কাঠ দিয়ে তৈরি যন্ত্রটি কীভাবে দুই হাজার বছর আগে এতো নির্ভুলভাবে তৈরি হয়েছিল তা ভাবলে সত্যিই এখনো অবাক হতে হয়।

সমুদ্র থেকে উদ্ধারকৃত সেই বিষ্ময়: অ্যান্টিকিথেরা মেকানিজম;Image source:Pinterest.com
টুরিং মেশিন
শিল্প বিপ্লবের এক পর্যায়ে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হয়। সামরিক কাজে কম্পিউটারের ব্যবহার তখন অনেক বাড়তে থাকে। এই যুদ্ধের সময়ই মানুষ প্রথম বুঝতে পারে যে তথ্য জিনিসটাও এক প্রকার শক্তি। অ্যালান টুরিং নামক একজন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী তখন প্রোগ্রামেবল কম্পিউটারের ধারণা দেন। কম্পিউটার বিজ্ঞানের দুটি মৌলিক ধারণার সাথে তার নাম জড়িত – টুরিং টেস্ট ও টুরিং মেশিন।

Image source: IEEE Spectrum
তিনি জার্মান নৌবাহিনীর গুপ্ত সংকেত বিশ্লেষনে নিয়োজিত হাট-৮ এর নেতৃত্বে ছিলেন। জার্মান সৈন্যরা সাংকেতিক ভাষায় তাদের বার্তা আদান প্রদান করতো। টুরিং এর তৈরি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক যন্ত্র জার্মানির এনিগমা মেশিনের কোড ডিকোড করতে পারতো। এই কোড গুলো এত বেশি দুর্বোধ্য ছিল যে, বড় বড় গণিতবিদদেরও এসব বুঝতে অনেক বেগ পেতে হতো। টুরিং এর অবদানের কারণে জার্মানদের কোড নিমিষে পড়ে ফেলতে পারতো আমেরিকানরা। টুরিং এর কম্পিউটারের বদৌলতে আমেরিকার জার্মান বধের পথ অনেক সহজ জয়ে যায়। টুরিং এর এতো অবদানের জন্যই তার নামে দেওয়া হয় “টুরিং পুরষ্কার” যা কিনা কম্পিউটার বিজ্ঞানের নোবেল নামে অভিহিত হয়।
আধুনিক কম্পিউটার
১৮৮৭ সালে ড: হরম্যান হলেরিথের যুক্তরাষ্ট্রের আদমশুমারীর কাজে ব্যবহার করার জন্য চার্লস ব্যাবেজ একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন। যা দ্বারা দ্রুত আদমশুমারির কাজ করা যেত। এই যন্ত্র তৈরি করতে তখন যে কোম্পানি সাহায্য করেছিল এর সাথে আরও কিছু কোম্পানি একত্র হয়ে গঠন করেছে বিখ্যাত আইবিএম কোম্পানি।
১৯৪৪ সালে তৈরি করা হয় Mark-1। যা ছিল প্রথম স্বয়ংক্রিয় ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ডিজিটাল কম্পিউটার। অধ্যাপক হাওয়ার্ড এইচ আইকেন ও IBM এর ৪ জন প্রকৌশলী মিলে তৈরি করেন এটি। ১৯৪৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারি তৈরি করা হয় প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটার ENIAC । ১৯৪৬ সালে প্রফেসর মরিস উইলকস EDSAC কম্পিউটার তৈরি করেন। ১৯৫১ সালে প্রথম বাণিজ্যিক ইলেক্ট্রিকাল কম্পিউটার তৈরি হয়। যার নাম ছিল UNIVAC-1। গণনা করা ছাড়াও কম্পিউটারটি পড়া ও তথ্য লেখার কাজ করতে পারতো।
১৯৪৮ সালে আবিষ্কৃত হয় ট্রানজিস্টর। এরপর ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট আবিষ্কৃত হলে কম্পিউটারের আকার ছোট হয়ে যায় এবং গুণগত মান ও কাজের গতি বেড়ে যায়। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম কম্পিউটার আসে ১৯৬৪ সালে। পরমাণু শক্তি গবেষণা কেন্দ্রে প্রথম কম্পিউটারটি স্থাপন করা হয়। IBM এর মেইনফ্রেম এটি ১৬২০ কম্পিউটার ছিল।
প্রযুক্তি এগোতে থাকে দ্রুত গতিতে। এর সাথে পুরোনো কম্পিউটার পরিবর্তিত হয়ে আরও আধুনিক ও কর্মক্ষম হয়ে উঠে। ১৯৭১ সালে আমেরিকার ইন্টেল কোম্পানি তৈরি করে মাইক্রোপ্রসেসর। এক বর্গ ইঞ্চি মাপের সিলিকন পাতের ভিতরে হাজার হাজার ট্রানজিস্টর বসিয়ে তৈরি করা হয় মাইক্রোপ্রসেসর। এই আবিষ্কারের ফলে কম্পিউটারের দাম চলে আসে মানুষের নাগালের মধ্যে, কাজের পরিধি বেড়ে দাড়ায় অনেক গুণ।
কম্পিউটারের প্রথম প্রজন্ম
ডিজিটাল কম্পিটারের প্রথম প্রজন্ম ধরা হয় ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ।

Image source: General Note
১৯৪৬ সালে পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন অধ্যাপক একটি কম্পিউটার তৈরী করেন যার নাম ENIAC, তবে প্রথম মেমোরি যুক্ত কম্পিউটার আবিষ্কার হয় ১৯৪৯ সালে , যার নাম EDSAC (Electronic Delay Storage Automatic Computer)। Remington Rand কোম্পানি ১৯৫১ সালে UNIVAC-1 কম্পিউটার তৈরি করে, যেখানে ভেকুয়্যাম টিউব এর ব্যবহার দেখা যায়। ১৯৫৪ সালে জনপ্রিয় IBM-650 কম্পিউটার তৈরি হয়।
প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারে যেসব বৈশিষ্ট ছিল সেগুলি হল –
- এই কম্পিউটার গুলি আকারে ও আতয়নে বড় ছিল।
- ভ্যাকুয়াম টিউবের ব্যবহার দেখা যেত।
- এই কম্পিউটারের প্রসেসিং ছিল ধীর গতিসম্পন্ন।
- এই প্রজন্মের কম্পিউটার অত্যধিক দামী ছিল।
- এই মেশিনে তাপ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হত।
- বিপুল সংখ্যক তথ্য ধারণ করতে পারত না। তথ্য ধারণক্ষমতা ছিল সীমিত।
- বিদ্যুৎ শক্তির খরচ ছিল অত্যধিক এবং অত্যধিক তাপ উৎপাদনকারী ছিল।
- ইনপুট ও আউটপুটের জন্য ব্যবহার করা হত পাঞ্চ কার্ড ও ম্যাগনেটিক টেপ।
- রক্ষণাবেক্ষণ প্রচুর ব্যয়বহুল ছিল।
প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারের উদাহরণ হল – ENIAC, EDSAC, BINAC, UNIVAC-1, MARK, IBM-650 ইত্যাদি।
দ্বিতীয় প্রজন্ম
কম্পিউটারের দ্বিতীয় প্রজন্ম হল ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল, ১৯৫৮ সালে Jack Cent Clear নামক একজন বিজ্ঞানী Integrated Circuit বা IC তৈরী করেন। দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারে ভ্যাকুয়াম টিউবের জায়গায় ব্যবহৃত হত ট্রানজিস্টার।

Image source: Computersadda
দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারের বৈশিষ্ট্য
- এই প্রজন্মের কম্পিউটারে ব্যবহার হত ট্রানজিস্টার ও ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট।
- প্রথম প্রজন্মের তুলনায় কম্পিউটারের আকৃতি ছোট ছিল।
- চৌম্বকীয় ক্যরস ব্যবহার।
- বিদ্যুৎ খরচ ও অনেক কম হত
- কার্য সম্পাদন গতির, প্রোগামিং ভাষা, ইনপুট ও আউটপুট ডিভাইস উন্নত মানের ছিল।
- টেলিফোন লাইনের মাধ্যমে ডেটা স্থানান্তরের সুবিধা ছিল।
- প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারের তুলনায় দাম কম।
- তাপ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা এই প্রজন্মের কম্পিউটারেও ছিল।
উদাহরণঃ IBM-1401, CDC-1604, RCA-501, NCR-304, Honeywell 200, PDP- I ,IBM- 7000IBM-1620, GE 200, IBM-1600 ইত্যাদি।
তৃতীয় প্রজন্ম
কম্পিউটারের তৃতীয় প্রজন্ম হল ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭২ সাল। এই প্রজন্মের কম্পিউটারে (SSI) সার্কিট এবং (MSI) সার্কিট ব্যবহৃত হওয়ার কারনে এই প্রজন্মের কম্পিউটারকে তৃতীয় জেনারেশন বা Integrated Circuit Computer বলা হয়।

Image source: Computer generations
তৃতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারে বৈশিষ্ট্য
- দ্বিতীয় প্রজন্মের তুলনায় আকারে আরও ছোট ছিল এই কম্পিউটার।
- ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (IC) এর ব্যাপক প্রচলন দেখা গেল।
- ভিডিও ডিসপ্লে ইউনিট, লাইন প্রিন্টার ইত্যাদি আউটপুট ডিভাইস প্রচলন।
- শুরু হল মাউসের ব্যবহার।
- এই প্রজন্মের কম্পিউটারের গঠন আরও জটিল হয়।
এই প্রজন্মের কম্পিউটারের উদাহরণ IBM-370, PDP-8, PDP-2, GE-600, IBM 960, CDC- 1700 ইত্যাদি।
চতুর্থ প্রজন্ম
১৯৭৩ সাল থেকে ২০০০ সালকে কম্পিউটারের চতুর্থ প্রজন্ম বলে ধরা হয়। Large Scale Integration এবং Very Large Scale ‘ Integration মাইক্রোপ্রসেসর এই প্রজন্মের কম্পিউটারে ব্যবহার করা হয়। উইন্ডোজ, ডস (DOS) অপারেটিং সিস্টেমের ব্যবহার শুরু হয় এই প্রজন্মে।

Image source: Computer Studies
চতুর্থ প্রজন্মের কম্পিউটারের বৈশিষ্ট্য গুলি হল –
- মাইক্রোপ্রসেসর এর উদ্ভব ও ব্যবহার শুরু হয় এই প্রজন্মের কম্পিউটারে।
- তথ্য সঞ্চয় ক্ষমতা পূর্বের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়।
- বিভিন্ন অপারেটিং সিস্টেমের ব্যবহার।
- মাইক্রোকম্পিউটারের প্রচলন বৃদ্ধি পায় এই প্রজন্মের কম্পিউটারে।
- তাপ নিয়ন্ত্রণের কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল না
- কম বিদ্যুৎ শক্তি প্রয়োজন হত।
এই প্রজন্মের কম্পিউটারের উদাহরণ হল –
IBM-3033, HP-3000, IBM-4341, TRS-40, IBM PC, DEC-10, STAR- 1000,PPR- II, APPLE- II, IBM- 4341
পঞ্চম প্রজন্ম
২০০১ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পঞ্চম প্রজন্মে খুব বেশি কিছু পরিবর্তন না হলেও এই প্রজন্মের কম্পিউটারে প্রসেসর, মেমোরী, তথ্য সঞ্চয় করার ক্ষমতা ইত্যাদি উন্নত মানের হয় চতুর্থ প্রজন্মের তুলনায়।

Image source: Jeju Pro
এই প্রজন্মের কম্পিউটারের বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
- বহু কাজ একসাথে দ্রুত করতে পারে এই প্রজন্মের কম্পিউটার ।
- প্রসেসরের গতি বৃদ্ধি হয় ।
- তাপ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা নেই এই প্রজন্মের কম্পিউটারে।
- অপারেটিং সিস্টেম উন্নত মানের হয়।
- এই প্রজন্মের কম্পিউটারে নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেটের ব্যবহার সাধারণের মধ্যেও দেখা যায়।
- এই প্রজন্মের কম্পিউটারের দাম পূর্বের চার প্রজন্মের তুলনায় অনেক কম।
এই প্রজন্মের কম্পিউটারের উদাহরণ হল – DEV VAX-780, Intel iPSC-1, Desktop, Laptop, Notebook, Ultrabook, Chrombook ইত্যাদি।
কম্পিউটারের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও সম্ভাবনা
একবিংশ শতাব্দীকে বলা হয়ে থাকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সমাহারের একক স্বায়ত্তশাসন । ইন্টারনেট যেভাবে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে বিশ্বমঞ্চে ঠিক তেমনি এর সাথে তাল মিলিয়ে কম্পিউটারের প্রতিযোগিতাও এখন অনেক উচ্চহারে বেড়েছে।কম্পিউটারের তুলনায় এখন ল্যাপটপ এবং ল্যাপটপের তুলনায় এখন ব্যবহার হচ্ছে ট্যাব এবং এর সবথেকে সংক্ষিপ্ত সংস্করণ মোবাইল ফোন যেটির মাধ্যমে এখন প্রায় কিছু ব্যতিক্রমধর্মী কাজ ব্যতীত সব কাজই সম্পন্ন করা সম্ভব । কিন্তু কম্পিউটারের মাধ্যমে যোগাযোগ মাধ্যম এবং তথ্য নিরাপত্তা বিষয়টিতে সর্বোচ্চ সুরক্ষা একমাত্র কম্পিউটার ব্যবহার করার মাধ্যমেই সম্ভব । সাধারণ হাতে গোনা গণনা থেকে শুরু করে আজ কম্পিউটার অসীম সংখ্যার গণনায় বিভিন্ন বিভাগের কাজে ব্যবহার হচ্ছে ।শক্তিশালী ডাটাবেসের তথ্য নিরাপত্তা থেকে শুরু করে সংরক্ষণ পর্যন্ত সকল প্রযুক্তির একমাত্র ব্যবহার মাধ্যম হল কম্পিউটার । দেশের সাধারণ একটি সরকারী ব্যাংক থেকে দেশের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সহিত গোয়েন্দা বিভাগের তথ্য সমষ্টির কর্মসংস্থানে কম্পিউটার নামক এই যুগান্তকারী বিস্ময় বিদ্যমান । যা অচিরেই আরো কয়েক শতাব্দী কায়েম থাকবে বলে প্রযুক্তি বিজ্ঞানি এবং বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞদের আশ্বাস।
স্যাটেলাইট সম্পর্কে অজানা সব তথ্য আর্টিকেলটি পড়তে ক্লিক করুন