অর্থনীতির দশটি নীতি নিয়ে আজকের আলোচনা

অর্থনীতির দশটি নীতি

আমাদের সমাজে সম্পদ স্বপ্লতার পরিপ্রেক্ষিতে অসমি অভাব মোকাবেলা করতে হয়। অর্থনীতিবিদ গ্রেগরি ম্যানকিউয়ের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তক অর্থনীতির দশটি মৌলিক নীতির কথা বলা হয়েছে। এগুলো নিম্নে দেওয়া হলোঃ

১. মানুষকে পেতে হলে ছাড়তে হয় (People Face trade-Offs):

পছন্দমতো কোন কিছু পেতে গেলে আমাদেরকে অবশ্যই পছন্দের অপর একটি জিনিস ত্যাগ করতে হয়। উদাহরণ দিয়ে বলি, আমি বা তুমি বা আপনি যদি অর্থনীতি বিষয়ে পড়তে মোট যে সময় ব্যয় করি, তাহলে বাংলা বা ইংরেজি বিষয় পড়া থেকে সেই ক্ষেত্রে আমাদের বিরত থাকতে হবে। এরূপ যদি টিভি দেখতে চাওয়, তাহলে  খেলা-ধুলার পেছনে সময় ব্যয় করতে পারবে না। সরকার যদি বাজেট সামরিক খঅতে বেশি ব্যয় করতে চায়, তাহলে শিক্ষাখাত সহ অন্যান্য খাতে ব্যয় কমাতে হবে। অর্থাৎ সমাজে মানুষ সর্বদা একটি দেওয়া-নেওয়ার নীতি মেনে চলেন।

২. সুযোগ ব্যয় (Opportunity Cost):

তুমি যদি স্কুলে পড়ার জন্য সময় ব্যয় কর, তবে তুমি তোমার বাড়িতে তোমার বাবার কাজে সাহা্য্য করতে পারবে না। অথচ তুমি বাড়িতে কোন একটি অর্থনৈতিক কাজ করলে তা থেকে তোমাদের পরিবার আর্থিকভাবে উপকৃত হতে পারত। কিন্তু সে সময তুমি স্কুলের লেখাপড়া করছ। এখানে লেখাপড়া করার জন্য বাড়িতে কাজ করতে না পারা লেখাপড়ার সুযোগ ব্যয়। সাধারণত যেসব সুযোগ ব্যয় থেকে তুমি বঞ্চিত হচ্ছো। তার মধ্যে সবচেয়ে দামি সুযোগটিকেই সুযোগ ব্যয় বলা হয়।

৩. যুক্তিবাদী মানুষ প্রান্তিক পর্যায় নিয়ে চিন্তা করে (Rational People Think at the Margin):

মানুষ প্রান্তিক চিন্তা করে। বিয়েবাড়িতে খাওয়া শেষে তোমরা কেউ কেউ ভাবো আরও একটু খেতে পারতাম, আবার কেউ কেউ ভাবে আর একটু কম খেলে ভালো হতো। এই অল্প একটু  বেশি বা অল্প একটু কম খাওয়া হচ্ছে প্রান্তিক খাওয়া। ধরো, তুমি একটি বিষয়ে পেলে, তোমার মনে হবে আর একটু পড়লেই এ+ পেতাম। মানুষ প্রান্তিক সুবিধা-অসুবিধার কথাও ভাবে। ধরো, তুমি পর পর তিনটি কলা খেলে। তিন নম্বর কলাটি হলো প্রান্তিক কলা। প্রান্তিক কলা খেয়ে তুমি যে তৃপ্তি পেলে, তার নাম প্রান্তিক উপযোগ। প্রান্তিক বা তিন নম্বর কলাটি পেতে তুমি যত টাকা ব্যয় করলে, তার নাম প্রান্তিক ব্যয়। যক্তিবাদী মানুষ হিসেবে তুমি তখনই প্রান্তিক কলাটি খাবে, যখন প্রান্তিক উপযোগ প্রান্তি ব্যয়ের চেয়ে বেশি হয়।

৪. মানুষ প্রণোদনায় সাড়া দেয় (People Respond to Incentives):

প্রতিটি কাজের জন্য উৎসাহ বা প্রণোদনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মানুষ প্রণোদনা পায় বলে কাজটি অধিকতর যত্নের সাথে করে। তোমার বাবা যদি বলেন তুমি পরীক্ষায় জি.পি.এ ৫ পেলে, তিনি তোমাকে একটি সাইকেল কিনে দেবেন। নিশ্চয়ই তোমার ভেতরে পড়াশোনা করার উৎসাহ আরও বাড়বে। তেমনি অর্থনীতিতে শ্রমিক প্রণোদনা পেলে বেশি উৎপাদন করে।

৫. বাণিজ্যে সবাই উপকৃত হয় (Trade cam Make Everyone Better-Off):

যুক্তরাষ্ট্র সস্তায় গাড়ি তেরি করে, তবে আমাদের রয়েছে সস্তায় পোশাক তৈরি সামর্থ। এখন আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্র এর সঙ্গে সস্তা পোশাকের বিনিময়ে সস্তা গাড়ির বাণিজ্য করি তাহলে আমাদের উভয়ের লাভ হবে।

৬। অর্থনৈতিক কার্যক্রম সংগঠিত করা জন্য সচরাচর বাজার একটি উত্তম পন্থাঃ

অর্থনৈতিক কাজকর্ম সচরাচর সংগঠিত হয়ে থাকে বাজারব্যবস্থার মাধ্যমে। ফার্ম ও পরিবারসমূহের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলেই কোন দ্রব্যের দাম নির্ধারিত হয়। ফার্মের মালিকরা বাজারের চাহিদা দেখে দ্রব্যের সরবরাহ করে এবং অসংখ্য পরিবার তাদের আয় ও প্রয়োজন অনুসারে এ সমস্ত দ্রব্য ও সেবাসামগ্রী ক্রয় করে। চাহিদা ও সরবরাহের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দ্বারা বাজারে দাম নির্ধারিত হয়।

৭. সরকার কখনো বাজার নির্ধারিত ফলাফলের উৎকর্ষ সাধন করতে পারেঃ

বাজার ব্যবস্থা সাধারণত নানাধরণের স্বতঃস্ফূর্ত চাহিদা ও সরবরাহের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে। বাজার ব্যবস্থা নির্দিষ্ট একজনের বদলে বহুজনের সম্মিলিত ‘অদৃশ্য হাতের ইশারায় চলে। কিন্তু সব সময় ব্যাপারটি সঠিকভাবে হয় না। নানা কারণে অদৃশ্য হাত সঠিকভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়। এমন অবস্থায় সরকারি হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়ে। গণদ্রব্য সরবরাহ যেমনঃ- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন-শৃঙ্খলা, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সম্পদের সুষ্টু ব্যবহারে অপারগতা, একচেটিয়া সম্পদের কেন্দ্রীভবন, পরিবেশদূষণ এবং দুর্ণীতির মতো বিষয়গুলো থেকে সমাজকে রক্ষা করার জন্য সরকারি হস্তক্ষেপের দরকার হয়। বাজারের হাত অদৃশ্য হলেও, সরকারের হস্তক্ষেপ দৃশ্যমান থাকে।

৮. একটি দেশের মানুষের জবিনযাত্রার মান নির্ভর করে সে দেশের দ্রব্য ও সেবা উৎপাদনের ক্ষমতার উপরঃ

যেসব দেশের মানুষের দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন করার ক্ষমতা বেশি, তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। উন্নত দেশসমূহের মানুষের উৎপাদন ক্ষমতা বেশি বলে তাদের মাথাপিছু আয় অনেক বেশি। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু আয় ৬২৭৯৪.৬ মার্কিন ডলার এবং জাপানের মাথাপিছু আয় ৩৯২৯০ মার্কিন ডলার (উৎস বিশ্বব্যাংক)। ফলে গড় পড়তা তারা উন্নত খাবার গ্রহণ, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, উন্নত নাগরিক সুবিধা লাভ করে। শ্রমিকদের কর্মক্ষমতাও বাড়ে। অল্প সময়ে, অল্প শ্রমে তারা অনেক বেশি দ্রব্য ও সেবা তৈরি করতে পারে।

৯. যখন সরকার অতি মাত্রায় মুদ্রা ছাপায়, তখন দ্রব্যমু্যে বেড়ে যায়ঃ

মুদ্রা ছাপানোর ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি অধিক মাত্রায় মুদ্রা ছাপায়, তাহলে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে অর্থাৎ দ্রব্যের মূল্যস্তর বাড়ে। মুদ্রাস্ফীতি ঘটলে অর্থের মান বা মূল্য কমে যায়। ধরো, তুমি ৫০০/- টাকা খরচ করলে লেখাপড়ার প্রয়োজনীয় সামগ্রী পেয়ে যাও। কিন্তু টাকার মান কমে যাওয়অয় ঐ সামগ্রী পেতে তোমাকে ৬৫০/-  টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে; যা পূর্বের ৫০০/- টাকার চেয়ে (৬৫০ – ৫০০) = ১৫০/- টাকা বেশি। জিনিসের দাম বাড়ায়িএকই জিনিস কিনতে এখন বেশি মুদ্রা লাগবে।

১০. সমাজে মুদ্রাস্ফীতি এবং বেকারত্বের মধ্যে স্বল্পকালীন বিপরীত সম্পর্ক বিরাজ করেঃ

দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যস্তর বেড়ে যাওয়ার অবস্থাকে মুদ্রাস্ফীতি বলে। আর কোন শ্রমিক বাজার মজুরিতে কাজ করতে ইচ্ছুক কিন্তু কাজ পায় না- এরা হলো বেকার। সাধারণত অর্তনীতির মুদ্রাস্ফীতি কমলে বেকারত্ব বাড়ে। আবার মুদ্রাস্ফীতি বাড়লে বেকারত্ব কমে।